ব্যাংক খাতে শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি
অর্থ পাচারে জড়িত আট প্রতিষ্ঠান
খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে -অধ্যাপক মইনুল ইসলাম
ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলসের মালিক মুহাম্মদ মহসিন পাচারের টাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি শিল্প প্লট কেনেন। প্লটটি কেনার জন্য মধ্যস্থতা করে স্টারাটা রিয়েলিটি ইন্টারন্যাশনাল নামে এক প্রতিষ্ঠান। মহসিনের নামে জমির রেজিস্ট্রেশন হয়। যার নম্বর ২০১২-০৪৪৮৫৬০। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তার একটি মামলা ঘিরে পুরো তথ্য জানা গেছে।
মহসিনসহ ব্যাংক খাতে সর্বশেষ শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপির তালিকার (অপ্রকাশিত) মধ্যে অবস্থান ১৭তম। ওই তালিকা ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইলসহ ৮ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে-রুবি ফুড, এফএমসি ডকইয়ার্ড লি., মাহিন এন্টারপ্রাইজ, ক্রিসেন্ট লেদার, প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লি., রিমেক্স ফুটওয়্যার লি., রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার। শুধু এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, দেশের ব্যাংক খাতে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের ৮০ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন দেশের অর্থনীতিবিদরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক হিসাবে এ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের প্রায় এক লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আজ দ্বিতীয় পর্বে তা তুলে ধরা হলো
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ পাচার প্রসঙ্গে বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুসরণ করে যারা দেশ থেকে টাকা নিয়ে গেছে, তাদের স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না। দেশীয় আইনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনেও তাদের নাজেহাল করা হবে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। ফেরত না এলেও পাচারকারীরা শান্তিতে ঘুমাতে পারবেন না। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এখানে একটি বিষয় খেলাপির সঙ্গে অর্থ পাচার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খেলাপি ঋণের বেশিরভাগই রাঘববোয়ালদের (ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি) কাছে আটকে আছে। খেলাপি ঋণের ৮০ ভাগের বেশি বিদেশে পাচার হয়ে গেছে, টাকা দেশে নেই। এসব দমন করতে যে কঠোর হওয়ার দরকার ছিল বিগত সরকার তা হয়নি, বরং ঋণখেলাপিদের আশকারা দিয়েছে। এর বড় প্রমাণ হচ্ছে, এক সময়ের শীর্ষ ঋণখেলাপি সদ্য বিদায়ি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বসে ছিলেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উঠে আসা শীর্ষ ত্রিশ খেলাপির মধ্যে সাদ মুসা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলস রয়েছে তালিকার ১৭তম অবস্থানে। এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৭৮৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি ঋণখেলাপি হলেও গ্রুপের চেয়ারম্যান মহসিনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। শুরুতে মহসিন খেলাপির তথ্য গোপন করে সাদ মুসা গ্রুপের কর্মকর্তা ও চাচাতো ভাই মঈন উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীকে এমডি দেখিয়ে ‘রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল মিল’ নামে কাগুজে প্রতিষ্ঠান খোলেন। পরে রেডিয়ামের নামে ব্যাংক থেকে ৭৫৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সরকারের সুদ ভর্তুকির আওতায় দেওয়া প্রণোদনা ঋণের ১৮৮ কোটি টাকা ব্যবসায় না লাগিয়ে নগদে তুলে নেওয়া হয়েছে। এভাবে নানা কৌশলে ঋণের টাকা ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান।
সূত্রমতে, ঋণের নামে ৭ হাজার ২০৫ কোটি টাকা বের করে নিয়েছে শীর্ষ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান ফুড প্রসেসিং কোম্পানি রুবি ফুড। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান কাজী আতফুল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠে। ওই অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা করে। অফশোর অ্যাকাউন্ট এবং শেল কোম্পানি খুলে অবৈধভাবে ১৪৮ কোটি টাকা পাচার করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রতিষ্ঠানে একদিকে পণ্য উৎপাদন করছে। ওই পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ইনভয়েসে কম মূল্য ঘোষণা করে রপ্তানি আয় কম দেখানো হয়। তবে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক রুবি ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী শনিবার যুগান্তরকে জানান, শীর্ষ ত্রিশ খেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রুবি ফুড প্রতিষ্ঠানটি তাদের নয়। তিনি আরও বলেন, রুবি ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত ঋণ সীমা ২৫০০ কোটি টাকা। ৭২০৫ কোটি টাকার ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান তার নয়। তবে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় নাম আসা রুবি ফুড প্রডাক্টস লিমিটেড একটি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বেভারেজ প্রতিষ্ঠান।
এদিকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে ২০২৩ সালে গোপনে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন মাহিন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান লস্কর। এ প্রতিষ্ঠান এখন শীর্ষ ঋণখেলাপির তৃতীয় অবস্থানে আছে। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে এক হাজার ২৫২ কোটি টাকা। ঋণখেলাপির পাশাপাশি অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। বিদেশে পণ্য ও সেবা আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে আন্ডার এবং অভার ইনভয়েস চালান তৈরি করে অর্থ পাচার করে মাহিন এন্টারপ্রাইজ। অর্থ পাচারের কৌশল হিসাবে বিদেশে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান ও স্বল্পনামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সেবা রপ্তানির নামে চুক্তি করে মাহিন এন্টারপ্রাইজ। এই চুক্তির আলোকে সেবা রপ্তানির নামে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়।
এদিকে শীর্ষ চতুর্থ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইয়াসিন চৌধুরী ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। চট্টগ্রামে তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা। বর্তমান তার খেলাপি ঋণের অঙ্ক এক হাজার ১৭৫ টাকা।
শীর্ষ ঋণখেলাপির ষষ্ঠ নম্বরে অবস্থান রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের। এ প্রতিষ্ঠানের খেলাপির অঙ্ক ১০৮৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এছাড়া রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যার ও ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রূপালী কম্পোজিট লেদারওয়্যারের খেলাপি ঋণ ৮৭৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টসের ৮৫৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ১ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে আলোচনায় আসে ক্রিসেন্ট লেদার। ২০১৯ সালের বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আমদানি-রপ্তানিসহ নানা উপায়ে ঋণ বের করে নিয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ। যার একটি অংশ পাচার হয়েছে। এ নিয়ে রাজধানীর চকবাজার মডেল থানায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ক্রিসেন্ট লেদার প্রডাক্টস লিমিটেড ৪২২ কোটি ৪৬ লাখ, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড ৪৮১ কোটি ২৬ লাখ ও ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ লিমিটেড ১৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পাচার করেছে। মোট টাকার পরিমাণ ৯১৯ কোটি ৫৬ লাখ।
শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় ফের উঠে এসেছে বাংলাদেশের প্রথম মুঠোফোন অপারেটর প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড বা সিটিসেল। এ প্রতিষ্ঠানের ঋণের অঙ্ক ১০৭১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১৬ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩২১ কোটি টাকা বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে মামলাও হয়।