Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ভারতের বাঁধ ভেঙে আসা ঢলে বন্যা

ব্যাপক ক্ষতি ফল ফসল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের

২০ হাজার কোটি টাকার ফল-ফসল বিনষ্ট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকার * ক্ষতিগ্রস্ত ৭ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার সড়ক ও ১ হাজার ৯৫টি ব্রিজ-কালভার্ট

Icon

আমিরুল ইসলাম

প্রকাশ: ৩১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাপক ক্ষতি ফল ফসল মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের

দেশে চলমান বন্যায় ফল-ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মাইলের পর মাইল রাস্তা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ধ্বংস হয়েছে হাজারো ব্রিজ, কালভার্ট, পুল ও সাঁকো। মৎস্যচাষিরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। আমন চাষিদের মাথায় হাত। এছাড়া ফলমূল, শাক-সবজি চাষিরা পথে বসে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এক কথায় বন্যার ধ্বংসলীলার শিকার ১১ জেলার অর্ধকোটি মানুষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় ২৪টি জেলার কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জেলায় ১৭ লাখ ৭২ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ করা হয়। এর মধ্যে তিন লাখ ৭২ হাজার ৭৩৬ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে এসব জেলার অন্তত ২০ শতাংশ ফসলি জমি বন্যায় আক্রান্ত। ক্ষতি হওয়া আবাদি জমির মধ্যে রয়েছে-আউশ ৭৪ হাজার ১১৬ হেক্টর, রোপা আমন দুই লাখ ৩৫ হাজার ৬৬৭ হেক্টর, বোনা আমন ৩৬ হাজার ২৪৮ হেক্টর, রোপা আমন বীজতলা ৪৪ হাজার ৯৯১ হেক্টর। এছাড়া শাক-সবজি ১৫ হাজার ৫৬১ হেক্টর, আদা ১৬১ হেক্টর, হলুদ ২৪৬ হেক্টর, আখ ৬৫৭ হেক্টর, পান ৬৪৭ হেক্টর, ফলের বাগান ১১ হাজার ৮০০ হেক্টর, মরিচ ১২৭ হেক্টর, তরমুজ ৫৬ হেক্টর, পেঁপে ২৩ হেক্টর, ভুট্টা তিন হেক্টর, পেঁয়াজ এক হেক্টর ও গ্রীষ্মকালীন টমেটো ১৫ হেক্টর। সব মিলিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ৮২২ হেক্টর জমির শাক-সবজি বিনষ্ট হয়েছে। এ পর্যন্ত কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতি অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।

সাবেক কৃষি সচিব ও কৃষি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, কৃষির এতবড় ক্ষতি আগে কখনো হয়েছে মনে পড়ে না। সরকারকে কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কৃষককে বিনামূল্যে সার, বীজ, ধানের চারা দিয়ে সহায়তা করা উচিত। তিনি আরও বলেন, যাদের মুরগির খামার বিনষ্ট হয়েছে তাদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়া একান্ত অপরিহার্য। মৎস্য চাষিদের প্রণোদনা নগদ সহায়তা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কৃষি বোঝেন এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে সরকারের পরামর্শ নেওয়া উচত বলে তিনি মন্তব্য করেন। 

কৃষি বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব জমিতে প্রায় ২০ লাখ টনের বেশি শস্য উৎপাদন সম্ভব হতো। যদি পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সঠিকভাবে না করা যায়, তাহলে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ফল ও ফসল বিনষ্ট হয়েছে বলে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসের পরিচালক মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখের পর আর আমন ফসলের মৌসুম থাকে না। সুতরাং আমন ফসলের বিশাল ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এখনো অনেক জেলায় পানি জমে আছে। দ্রুত বীজতলা করে আবার আমন ফসল ফলাতে বেশ সমস্যা হবে। সরকার কিছু কিছু জায়গায় কৃষকদের মধ্যে বীজ ধান বিতরণ করেছে। তবে ১৫ সেপ্টেম্বরের পর অন্য ফসলে চলে যাওয়াই ভালো হবে। কারণ কৃষি গবেষকদের মতে, তখন আর আমনের মৌসুম থাকে না। 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে এ পর্যন্ত আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগের ১২টি জেলার ৮৬টি উপজেলা বন্যাকবলিত হয়। বন্যায় জানমালের ক্ষতিসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে অনেক গবাদিপশুর মৃত্যু এবং ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। 

বন্যায় লাখ লাখ টন গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য নষ্ট হয়। এই খাতে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দুধ, ডিমসহ প্রায় ৪১১ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত পুকুর/দিঘি/খামারের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার ৮৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্ত মাছ ও চিংড়ির পরিমাণ ৯০ হাজার ৭৬৮ মেট্রিক টন, ৩ হাজার ৭৪৬ লাখ মাছের পোনা ও চিংড়ির পোস্ট লার্ভা বিনষ্ট হয়েছে। এতে অবকাঠামোসহ মোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৯৫২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। 

মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জিল্লুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ক্ষতি তো বলে শেষ হবে না। প্রাথমিক হিসাবে যা পাওয়া গেল তা উল্লিখিত পরিসংখ্যানে তুলে ধরা হলো। পরবর্তী জরিপে ফাইনালি পরিপূর্ণ ক্ষতি আসবে। 

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে, প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১ হাজার ৯৫টি ব্রিজ-কালভার্ট। এ পর্যন্ত এলজিইডি মেরামত করেছে ৫১ কিমি. রাস্তা ও ৯৬টি ব্রিজ-কালভার্ট। এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজের) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৭৭৩.৪৫ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক ১০৭.০৫ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ১২৩.৭৪ কিলোমিটার এবং জেলা মহাসড়ক ৫৪২.৬৬ কিলোমিটার। 

বর্তমানে ২২টি সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ১৯টি সড়ক পানির নিচে থাকায় এবং তিনটি সড়কে কালভার্ট ওয়াশ আউট হওয়ায় যান চলাচল বন্ধ আছে। প্রবল বন্যায় বিভিন্ন সড়ক আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে সড়কবাঁধ ধসে পড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। কবে থেকে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া সড়ক মেরামত শুরু হবে জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কাজ চলমান। যেসব জেলায় পানি নেমে গেছে, সেসব স্থানে মেরামতকাজ শুরু হয়ে গেছে। আর যেসব জেলায় এখনো পানি রয়েছে সেসব স্থানে পানি নামার পর মেরামত শুরু হবে। আমরা মাঠে আছি, কাজ করছি। সড়ক মেরামত শেষে কর্মীরা ঘরে ফিরবে। 

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে প্রায় ১০ কিলোমিটার এবং ফেনীর লালপোলে প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে ছিল। ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এ মহাসড়কে জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের কাজ চলছে। যান চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন পাহাড়ি সড়কে ভূমিধসের কারণে যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে এবং জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম