Logo
Logo
×

শেষ পাতা

উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ

সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল দেখেনি আলোর মুখ

শেখ মামুনুর রশীদ

শেখ মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল দেখেনি আলোর মুখ

ছবি সংগৃহীত

বিচারপতি নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল-২০১২ ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবীসহ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। এ মুহূর্তে সংসদ কার্যকর না থাকলেও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এটি কার্যকর করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা। বিচারাঙ্গনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে এর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ছাত্র-জনতার তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের আরও পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। তারা হলেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন। দলীয় বিবেচনায় বিচারপতি পদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ ছিল তাদের বিরুদ্ধে। এর পরপরই বিচারাঙ্গনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়নের দাবিটি নতুন করে সামনে আসে।

শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই স্বাধীনতার পর থেকে কোনো সরকারই এ সংক্রান্ত আইন করেনি। কিন্তু যোগ্যতর ব্যক্তি বাছাই করার স্বার্থেই বিচারক নিয়োগে আইন জরুরি। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না রোববার যুগান্তরকে বলেন, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকে, তারা চায় না বিচারপতি নিয়োগে আইনটি হোক। অথচ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যেই বিচার বিভাগের উচিত এ আইন প্রণয়নের বিষয়ে আরও বেশি তৎপর হওয়া।

একই বিষয়ে সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগের জন্য সংবিধানে আইন প্রণয়নের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা গত ৪৬ বছরে হয়নি। তিনি জানান, ১৯৭৮ সালে বিধানটি সংবিধানে যুক্ত হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে এবং আইন কমিশন থেকেও এ বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু আজও আইন প্রণয়নের কাজটি হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যোগ্যতা এবং দক্ষতাকে বিবেচনায় নিয়ে বিচারক নিয়োগের জন্য ২০১২ সালে জাতীয় পার্টির তৎকালীন সংসদ-সদস্য, সাবেক বিচারক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মুজিবুল হক চুন্নু ‘সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল-২০১২’ নামে একটি বেসরকারি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। পরে এটি নিয়ে ওই সময় বেসরকারি বিল পরীক্ষা সম্পর্কিত সংসদীয় বাছাই কমিটিতে কয়েক দফা আলোচনা হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদসহ একাধিক সিনিয়র আইনজীবী বিলটির ওপর মত দেন। তারা বিলটি তখন জাতীয় সংসদে পাশের জন্য সুপারিশও করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আলোর মুখ দেখেনি সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল।

মো. মুজিবুল হক চুন্নু বর্তমানে জাতীয় পার্টির মহাসচিব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ছয়বারের সংসদ-সদস্য মো. মুজিবুল হক চুন্নু সংসদে উত্থাপিত আইনটির উদ্দেশ্য ও কারণে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের জন্য যোগ্যতা নির্ধারণ করে আইন প্রণয়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে।

কিন্তু স্বাধীনতার এত বছরেও এ নিয়ে কোনো আইন হয়নি। এতে আরও বলা হয়েছে, বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সততা ও যোগ্যতার পরিবর্তে রাজনৈতিক বিবেচনা অগ্রাধিকার পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ফলে একদিকে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের যোগ্যতা, সততা, নিরপেক্ষতা, কর্মদক্ষতা ও বিচারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে; অন্যদিকে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দেশের অগ্রযাত্রা বারবার ব্যাহত হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে লাখ লাখ মামলা বিচারাধীন। এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে জনগণকে প্রতিকার দিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিচারক প্রয়োজন। সংবিধানে বিচারক নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে এ মুহূর্তে কতজন বিচারক প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণ করতে কোনো আইনি ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। রাষ্ট্রপতিকে এ বিষয়ে সময়ে সময়ে সুপারিশ করা প্রয়োজন।

সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিলে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের পদসংখ্যা নির্ধারণ ও রাষ্ট্রপতির কাছে বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করতে সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন গঠনের বিধান রাখা হয়। সাত সদস্যের এ কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন পদাধিকারবলে প্রধান বিচারপতি। বিলে বিচারপতিদের রাজনৈতিক পরিচয়মুক্ত থাকার শর্ত যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীদের মধ্য থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক বা অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের জন্য দুটি শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে-সর্বশেষ ১০ বছরের পরিচালিত মামলার মধ্য থেকে প্রতিবছর অন্তত দুটি মামলার রেকর্ড পর্যালোচনা এবং পেশাগত আচরণ সম্পর্কিত বার কাউন্সিলের প্রতিবেদন পর্যালোচনা।

প্রস্তাবিত আইনে অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক/অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, এ আইনের অন্যান্য বিধানে যাই থাকুক না কেন, কমিশন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক/অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে শতকরা ৫০ ভাগ অধস্তন আদালতে কর্মরত বিচারকদের মধ্য থেকে সুপারিশ করবে। সুপ্রিমকোর্টের তিন ধরনের বিচারক নিয়োগে কমিশন কাজ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে আপিল বিভাগের বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক।

বিলে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক ও অতিরিক্ত বিচারক পদে নিয়োগে ৫টি শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো জাতীয় বা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল বা সহযোগী গঠনের অতীত বা বর্তমান সংশ্লিষ্টতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাজীবনের সব স্তরে ন্যূনতম দ্বিতীয় বিভাগ বা সমস্তরের গ্রেডিং নম্বর থাকতে হবে। এছাড়া আইন বিষয়ে অন্যূন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও বিলটিতে শপথ নেওয়ার দিন বিচারকের বয়স অন্যূন ৫০ বছর হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে আপিল বিভাগে বিচারক পদে নিয়োগের জন্য কমিশন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জ্যেষ্ঠতা, বিচারিক দক্ষতা, সততা, সুনামসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয় বিশদভাবে বিবেচনা করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এটা সাত সদস্যবিশিষ্ট হবে। এর চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতি। ছয় সদস্যের মধ্যে থাকবেন আপিল বিভাগের প্রবীণ বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের প্রবীণ বিচারক, স্পিকার-মনোনীত একজন সংসদ-সদস্য, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, অ্যাটর্নি জেনারেল এবং সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।

বিলে আরও বলা হয়েছে, এর মধ্যে কোনো সদস্যের নাম সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে বিচারক পদে নিয়োগের জন্য কমিশনে উপস্থাপিত হলে ওই সদস্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে পারবেন না। কমিশনের সাচিবিক দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। বিচারক বাছাই পদ্ধতি সম্পর্কে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কমিশন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক/অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদের বিপরীতে দুইজন ব্যক্তির নাম বাছাইপূর্বক সুপারিশ করবে।

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে মো. মুজিবুল হক চুন্নু রোববার যুগান্তরকে বলেন, সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদে বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এ কারণে ২০১২ সালে সংসদ-সদস্য থাকা অবস্থায় আমি প্রথমবার এ সংক্রান্ত একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন করি। সুপিরিয়র জুডিশিয়াল কমিশন বিল-২০১২ নামে বিলটি নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয়। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজটিও সমাপ্ত হয়। সবার মতামত নিয়ে ওই সময় বিলটি পাশেরও সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আর এটি পাশ হয়নি।

পরে ২০১৯ সালে আবার আমি বিলটি নতুন করে সংসদে উত্থাপন করি। তখনও অজ্ঞাত কারণে বিলটি আর আলোর মুখ দেখেনি। তিনি আরও বলেন, বিচারপতি নিয়োগে আইন থাকলে আজ যেসব বিতর্ক উঠছে, তা উঠত না। বিচারাঙ্গনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে আইনটি করা জরুরি। সংসদ না থাকলেও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ দিয়েও এটি কার্যকর করা যেতে পারে।

সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ দেবেন। সংবিধানে বিচারক হওয়ার জন্য আইন পেশায় ১০ বছর মেয়াদ বা বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার (অধস্তন আদালতের বিচারক) পদে ১০ বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত আছে। আবার সংবিধানের ৯৫(৩) অনুচ্ছেদে বিচারক নিয়োগের জন্য যোগ্যতর ব্যক্তি বাছাইয়ে আইন করার কথাও বলা আছে। ওই আইন বা নীতিমালা না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সরকারগুলোর প্রতি দাবি জানানো হচ্ছিল।

২০১২ সালের ৩ জুলাই সংসদ এবং ২০১৪ সালের ১৯ আগস্ট আইন কমিশন থেকে বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়। উচ্চ আদালতের একাধিক রায়েও বিচারপতি নিয়োগে আইন প্রণয়নের জন্য কয়েক দফা নির্দেশনা রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার তা হয়নি।

স্বাধীনতার পর ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার বিচারপতি নিয়োগে গাইডলাইন দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। পূর্ববর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে অস্থায়ী ১০ বিচারপতিকে বাদ দেওয়া সংক্রান্ত এক মামলার রায়ে ২০১০ সালে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এমএম রুহুল আমীনসহ পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ সেই গাইডলাইন দেন।

এতে বলা হয়, ‘রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেবেন এবং তারা পরস্পর চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা টেবিলে বসে পরামর্শ করতে পারেন। কিন্তু এ শলাপরামর্শের প্রক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে তাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার রেকর্ড রাখতে হবে, যাতে বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে যেন সহজেই তা নিরসন করা যায়।’ পরবর্তী সময়ে আরও কয়েকটি রায়েও এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম