Logo
Logo
×

শেষ পাতা

তিনটা বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে রিয়ান

আমি চাই ছেলের নামটি শহিদের তালিকায় থাকুক -বাবা গোলাম রাজ্জাক * রিয়ানের বিশ্বাস ছিল স্বাধীন দেশে কেউ হয়তো তাকে গুলি করবে না

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তিনটা বুলেটের আঘাতে লুটিয়ে পড়ে রিয়ান

সরকার পতনের খবরে ৫ আগস্ট বিকালে বিজয় মিছিল নিয়ে শ্যামলীর খিলজি রোড হয়ে রিং রোডে ঢুকছিল নাসিব হাসান রিয়ান (১৭) ও তার বন্ধুরা। তখনো মারণাস্ত্র হাতে পুলিশের একটি দল সেখানে (রিংরোড) ওতপেতে ছিল। কিন্তু রিয়ানের বিশ্বাস ছিল স্বাধীন দেশে কেউ হয়তো তাকে গুলি করবে না। মিছিলের অগ্রভাগে থেকে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠা সাহসী রিয়ান দুই হাত দুই দিকে প্রসারতি করে পুলিশের উদ্দেশে বলতে থাকে-‘গুলি করবি? কর’! এমনটা শোনামাত্রই ঘাতক পুলিশ ওদের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে গুলি ছোড়ে! শরীরে একে একে তিনটা বুলেট বিঁধলে আঘাত সহ্য করতে না পেরে কিশোর রিয়ান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে! প্রথম বুলেটটি বুকে লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়! দ্বিতীয়টি কানের নিচে দিয়ে ঢুকে গলা ভেদ করে! তৃতীয় বুলেটটি বুকে-কাঁধে লেগে মাংস ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়...! কথাগুলো যুগান্তরকে বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন শহিদ নাসিব হাসান রিয়ানের বাবা কৃষি কর্মকর্তা মো. গোলাম রাজ্জাক।

ছেলের মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে কষ্টে নিজের বুক চাপড়িয়ে এই বাবা বলতে থাকেন, ‘ওরা আমার ছেলেটাকে গুলিতে গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত করেছে! আমার সোনার টুকরো ছেলেকে মারতে কি এত বুলেট লাগে! না জানি কতটা কষ্ট পেয়ে ছেলেটা মারা গেছে!’

গোলাম রাজ্জাক যুগান্তরকে জানান, তার তিন ছেলে, রিয়ান মেজো, বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। রিয়ান ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাশ করে ‘বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কলেজে ভর্তি হয়েছিল। আমি ওকে ছাত্রদের আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেছি, কিন্তু আমাদের না জানিয়ে চুপিচুপি চলে যেত। ১৮ জুলাই যখন ওর বন্ধু ‘ফারহান ফাইয়াজ’ মারা যায়, তারপর থেকে তাকে কোনোভাবেই আর মানানো যাচ্ছিল না। আমাদেরকে বলত, ‘ন্যায্য দাবি চাইতে গিয়ে আমার ভাইয়েরা মরে যাচ্ছে, আমি কিছুতেই ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমি বাঁচতে চাই না, বাবা; আমিও মরে যাব; আন্দোলনে গিয়ে মরলে মরব।’

আমাকে আরও বলত, ‘বাবা আমার বন্ধু মারা গেছে, ছাত্ররা মারা যাচ্ছে, আমি আন্দোলনে যাব, তুমি আমাকে নিষেধ করো না বাবা; মানুষতো সবাই একদিন মরে যাবে।’

রিয়ানের মা শাম্মী আক্তার বলেন, ওরা বিকাল ৪টার দিকে মিছিল নিয়ে খিলজি রোড দিয়ে রিংরোডে ঢোকে। আমাদের উপরতলার একটা ছেলে মিডিয়াতে কাজ করে, রিংরোডে ছবি তুলতে গিয়ে, দেখেছে, রিয়ান গুলি খেয়েছে! সে তার মাকে জানিয়েছে। আমি ছাদে শুকাতে দেয়া কাপড় আনতে গিয়ে, শুনতে পাই ওরা বলাবলি করছে-‘রিয়ান গুলি খাইছে’! একথা শোনামাত্রই আমি দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় এসে ওর আব্বাকে বলি, ‘আমার রিয়ান কই, ‘আমার রিয়ান কই!’

বাবা রাজ্জাক বলেন, একথা বলেই ওর মা দেখি ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে, আর বলছে, ‘আমার রিয়ানের কি হলো, কি হলো’, আমিও সঙ্গে সঙ্গে বাসার নিচে নেমে যাই; তখনি, আমার বড় ছেলে রাফি ফোন দিয়ে বলে, ‘আব্বু তুমি কই, শিগগিরই আসো, রিয়ান গুলি খাইছে।’ প্রথমে রিংরোডে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিই, ওর বন্ধুরা বলে বেঁচে আছে, দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন আমার মনে হয়েছে, ছেলে আর নেই। সেই সময় রিংরোডের মুখে চারটা ডেডবডি পড়ে ছিল, তখনো প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে, একটু থামলে অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে এক আত্মীয়ের গাড়িতে ওকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাই।

গোলাম রাজ্জাক জানান, ‘সেদিন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এত লাশ, এর আগে কখনো দেখিনি! আমার মনে হয় ওই হাসপাতালেই ২০০ লাশ দেখেছি। চারতলার প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে ৮, ১০, ১২টা করে গুলিবিদ্ধ লাশ ছিল। আমার ছেলেকে ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেল, একটা পাইপ মুখে ঢুকিয়ে পাঞ্চ করল, এরপর চিকিৎসক বললেন ‘ও অনেক আগেই মারা গেছে, আনতে অনেক দেরি হয়ে গেছে!’ এরপর আমরা পোস্টমর্টেম (ময়নাতদন্ত) ছাড়াই লাশ নিয়ে আসি। শ্যামলী জামে মসজিদে রাত ১২টার দিকে নিজ হাতে ছেলেকে গোসল করালাম। ওখানেই প্রথম জানাজা দিয়ে রাত ১টার দিকে কেরানীগঞ্জের (রিয়ানের নানাবাড়ি) আমবাগিচা গোরস্থানে ওর নানার কবরের পাশে লাশ দাফন করেছি।’

সরেজমিন শ্যামলীতে রিয়ানের শোয়ার ঘরে গিয়ে দেখা যায়, পড়ার টেবিল ও সেলফে বই, ব্যাগ থরে থরে সাজানো। দেয়ালে ঝুলছে বেল্ট, পরিপাটি বিছানা, নেই শুধু বিছানায় আয়েশ করে বিশ্রাম নেওয়া বাবা-মায়ের আদরের রিয়ান। ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দেখিয়ে বাবা রাজ্জাক বলেন, টম ও জেরি নামে রিয়ানের দুটি পোষা বিড়াল আছে। ওর মৃত্যুর পর বিড়াল দুটো দিনরাত কেঁদেছে।

রিয়ানের মা জানান, গত কুরবানির ঈদের পরের দিন সকালে বন্ধুদের সঙ্গে চাঁদপুর যায়, সেখানে গিয়ে পানিতে ডুবে গিয়েছিল। পরে অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেই সময় সে লাইফ সাপোর্টে ছিল। ২ দিন পরে ওর জ্ঞান ফিরেছে। তখন একবার ও মৃত্যু থেকে বেঁচে যায়। ওকে বলেছি, দেখ, আল্লাহ একবার তোকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে, বারবার কি এমন হবে? তুই মৃত্যুটাকে এত খেলা মরে করিস কেন? ও বলত মরলে মরব। ছেলের ইচ্ছে ছিল পাইলট হবে। আমি বলতাম তোমাকে ডাক্তারি পড়াব, ও বলত আমি পাইলট হব, ছোট ভাই রাফসানকে তুমি ডাক্তারি পড়াইয়ো।

বাবা রাজ্জাক জানান, আমি চাই ছেলের নামটি শহিদের তালিকায় থাকুক। কবরটি সরকারিভাবে বাঁধানো হোক। আমাদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে একটি মসজিদের কাজ শুরু করেছি, সেটি দ্রুত করতে পারলে শহিদ ছেলের নামটি জুড়ে দিতে পারতাম।

তিনি আরও বলেন, শ্যামলীর কোনো একটা রাস্তা রিয়ানের নামে নামকরণ করা হোক। তাতে আমার রিয়ান মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবে। পরবর্তী প্রজন্ম দোয়া ও শ্রদ্ধাভরে রিয়ানকে স্মরণ করবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম