নিহত হওয়ার আগে মাকে ফোনে কুমিল্লার রাসেল
দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরব মা, মরে গেলে শহিদ হব
আবুল খায়ের, কুমিল্লা
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জহিরুল ইসলাম রাসেল। কাজ করতেন একটি পাদুকা কারখানায়। বিবেকের তাড়নায় যোগ দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। টানা ১০ দিন ছিলেন রাজপথে। প্রতিদিন সকালে ফেসবুকে নিজের ওয়ালে ঘোষণা দিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিতেন। সরকার পতনের মাহেন্দ্রক্ষণে ৪ আগস্ট দুপুরে আন্দোলনের সম্মুখসারিতে থেকে ঢাকার গুলিস্তানে পুলিশের গুলিতে নিহত হন এই অকুতোভয় যুবক। সেদিন সকালে মায়ের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। মাকে বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরব মা, যদি মরে যাই তাহলে শহিদ হব। মৃত্যুর কতদিন পেরিয়ে গেলেও এই সংগ্রামী যুবকের পরিবারের খবর রাখেনি কেউ। একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে রাসেলের পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জহিরুল ইসলাম রাসেল কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ইউসুফপুর ইউনিয়নের মৃত শাহ আলম সরকারের একমাত্র ছেলে। সে ছৈয়দপুর কামিল মাদ্রাসার ফাজিল দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পরিবারের দুমুঠো আহার জোগাড় করতে লেখাপড়ার পাশাপাশি ঢাকায় একটি জুতার কারখানায় কাজ করতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ায় নেমে পড়েন রাজপথে। মনে রাখেননি পরিবারের পিছুটান কিংবা স্ত্রী-সন্তানের কথা।
পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রতিবাদী টগবগে এ যুবকের প্রত্যাশা ছিল কখন এ দেশ দানবের কবল থেকে মুক্ত হবে! তাই পরিবারসহ সবার বাধা উপেক্ষা করে আন্দোলনে ছুটে গেছেন একেবারেই আওয়ামী লীগের আস্তানাখ্যাত গুলিস্তানে। বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ হারান তিনি।
রাসেলের এমন মৃত্যুতে শোকের পাশাপাশি চরম বেকায়দায় পড়েছে তার পরিবার। একটি কন্যা সন্তান নিয়ে বিপাকে স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী। রাসেলের শিশু মেয়ে বাবাকে খুঁজছে। বাবা কোথায় গেছে কখন আসবে প্রশ্ন করছে মাকে। বাবা কবরে ঘুমাচ্ছে বললে সে কবরে গিয়ে বাবার সঙ্গে ঘুমাতে চায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত রাসেলের এমন আত্মত্যাগ যেন দ্রুত ভুলে যাচ্ছে সবাই। এ পর্যন্ত নিহতের পরিবারের খোঁজ নেয়নি কেউ। দানবীয় শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী এই যুবকের পরিবার যেন সরকারের যথাযথ সহায়তা পায় এমন দাবি এলাকাবাসীর।
রাসেলের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, আমি আমার সন্তানকে কী পরিচয়ে মানুষ করব। আমার স্বামী প্রতিদিন ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নামত। সব ছাত্রকে উৎসাহিত করত। তার দেওয়া পোস্টগুলো ফেসবুকে এখনো আছে। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করে আমার ছোট্ট মেয়েটাকে এতিম করেছে, আমি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা মোর্শেদা বেগম বলেন, অল্প বয়সে আমার বউমা বিধবা হলো। নাতিন বাপকে হারাল। আমি আমার একমাত্র বুকের ধন হারালাম। অভাবের সংসারের ঘানি টানতে ছেলেকে ঢাকায় চাকরি করতে পাঠাইছিলাম। ফিরল লাশ হয়ে। ঢাকায় গণ্ডগোল শোনার পর ফোনে বারবার বলছিলাম বাবারে তুমি ওইসব আন্দোলনে যাইও না। নিষেধ করছি তাও শুনে নাই। উলটো আমারে কইত, ‘মা দেশ স্বাধীন করতে নামছি। স্বাধীন করেই ঘরে ফিরব। মাঝপথে ফিরে কাপুরুষ। আমি আন্দোলনে না গেলে আর কে যাবে! যদি মরে যাই শহিদ হব। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। এসব বলে বলে আমাকে বুঝাইত। যে দিন আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয় সেদিন সকালে আমার সঙ্গে কথা হয়। আমি নিষেধ করছিলাম যাইতে। তবুও গেছে। দুপুরে আমার ছেলে গুলিবিদ্ধ হইছে শুনে আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। পরের দিন বাড়িতে দেখি কফিনে আমার ছেলে লাশ হইয়া শুইয়া আছে।