Logo
Logo
×

শেষ পাতা

আনিসুল-সালমানের ক্ষমতার চরম অপব্যবহার

সাজানো মামলায় নিঃস্ব ব্যবসায়ী মুনির

Icon

নেসারুল হক খোকন

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাজানো মামলায় নিঃস্ব ব্যবসায়ী মুনির

সালমান এফ রহমানের অযাচিত হস্তক্ষেপে নিঃস্ব হয়ে গেছেন ব্যবসায়ী শফিউল্লাহ আল মুনির। গুলশানের ইনডেক্স গ্রুপের মালিক তিনি। তার বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর নামে দখল করারও অভিযোগ করেছেন তিনি। ব্যবসায়ীর সংসারও ভেঙেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক এই উপদেষ্টা। পরে ব্যবসায়ীর স্ত্রীকে কবজায় নিয়ে ১৪টি সাজানো মামলায় আসামি করা হয়। এসব মামলায় দেড় বছর জেলে বন্দি রেখে ইনডেক্সের নামে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রাতারাতি বদলে ফেলে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন তিনি।

জানতে চাইলে ইনডেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল্লাহ আল মুনির যুগান্তরকে বলেন, সালমান এফ রহমান ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেড দখল করার পর নাম পরিবর্তন করে বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-১ এবং বেক্সিমকো এলপিজি ইউনিট-২ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গঠন করেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি প্রায় ১৮শ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা নিয়েছেন। গ্লোবাল এলপিজি (মুনিরের প্রতিষ্ঠান) দখল করে এই প্রতিষ্ঠানের নামে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ সুবিধা গ্রহণ করেন সালমান এফ রহমান। ইনডেক্স লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান করোনা চলাকালীন ব্যাংকের ঋণ সুবিধায় হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেমিক্যাল আমদানি করে। সে সময় সাজানো মামলায় তাকে কারাগারে রেখে তার (মুনির) স্ত্রী জাকিয়া তাজিন ও সালমান রহমান এই কেমিক্যাল বিক্রি করে ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

শফিউল্লাহ আল মুনিরের অভিযোগ-ইনডেক্স গ্রুপ সীমান্ত ব্যাংক থেকে ইনডেক্স হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নামে ৮৫ কোটি টাকার একটি আর্থিক সুবিধা পান। গ্রুপটি এই সুবিধা দিয়ে কাজ শুরু করার কিছু দিনের মধ্যেই সালমান এফ রহমান প্রভাব খাটিয়ে সীমান্ত ব্যাংকের এই সুবিধা বাতিল করান। এভাবে চলমান কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস সিভিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অধীনে ইনডেক্স গ্রুপের দুটি চলমান প্রকল্প সালমান এফ রহমান তার ক্ষমতা বলে বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেন। যার আর্থিক ক্ষতি প্রায় ২০ কোটি টাকা। পাশাপাশি ইনডেক্স গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান এগ্রো ইনডেক্স প্রতিষ্ঠানটিকে সালমান এফ রহমান এবং জাকিয়া তাজিন যৌথভাবে দখল করেন। দখলের পর আইএফআইসি ব্যাংক থেকে এই প্রতিষ্ঠানের নামে মোট অঙ্কের অর্থ ঋণ সুবিধা গ্রহণ করা হয়। এসব ঘটনার একপর্যায়ে ২০০০ সালে জাকিয়া তাজিন তালাকের নোটিশ পাঠায় শফিউল্লাহ আল মুনিরের কাছে।

যত মামলা : সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৬ জুন রাত ১১টায় সাদা পোশাকধারী ৬-৭ জন বাসা থেকে শফিউল্লাহ আল মুনিরকে তুলে নিয়ে যায়। একজন প্রভাবশালীর দ্বারা নাজেহাল হতে পারেন-এমন আশঙ্কা করে ব্যবসায়ী মুনির সাধারণ ডায়েরি করে রেখেছিলেন গুলশান থানায়। আদালতে হাজিরা ছাড়াই ১ মাস অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয় তাকে। ওই বছরের ২৮ আগস্ট গুলশান জোনের ডিসি (ডিবি) মশিউর রহমান ও তৎকালীন এডিসি (বরখাস্ত) গোলাম সাকলাইনের নিয়ন্ত্রণ থেকে তাকে কোর্টে চালান করা হয়। পরিবারের সদস্যরা ওইদিন আদালতের গারদখানায় গিয়ে জানতে পারেন তার ওপর নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার চালানো হয় ডিবি হেফাজতে। এ সময় ব্যাংকের চেক ও অফিশিয়াল ডকুমেন্টে জোর করে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। তার দুটি গোডাউনে থাকা দেড়শ কোটি টাকার কেমিক্যাল বিক্রি করে দেন সালমান এফ রহমান ও মুনিরের স্ত্রী জাকিয়া তাজিন। ওই সময় বিভিন্ন ব্যাংকে তার প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার বেশি সিসি ও এলসি লিমিট ছিল। সেখান থেকে শুরু হয় ভুয়া বাদীর মাধ্যমে একের পর এক মামলা। এভাবে ১৪টি মামলা করা হয় এই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন টিভিতে মুনিরকে প্রতারক, চাঁদাবাজ ও মাদক ব্যবসায়ী আখ্যায়িত করে একের পর এক সংবাদও প্রচার করা হয়।

এ প্রসঙ্গে মুনির বলেন, চাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে, ২০২০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি জেলে। ওই সময় গুলশান থানায় করা একটি মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট করতে আদালতে আবেদন করা হয়। সেটি ছিল পুরোনো (পেন্ডিং) মামলা। পুলিশের এজাহারে তার নামও ছিল না। পরে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নির্দেশে তাকে মামলায় আসামি করা হয়। পরবর্তী সময়ে এ মামলায় মুনিরের জামিন হলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন বাতিলের আবেদনও করান আনিসুল হক।

মুনির আরও বলেন, মদের মামলায় আমাকে জেলে রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা। জামিন বাতিলের আবেদনে ‘মুনির সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তার কাছে মদের বোতল পাওয়া গেছে’ দাবি করা হয়। বিচারকও এই তথ্য আমলে নিয়ে জামিন বাতিলের আদেশ দেন। বুঝতে আর বাকি রইল না আনিসুল হকের ক্ষমতায় আমি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। এরপর যখনই মুনির একটা মামলায় জামিন পেয়েছেন তৎক্ষণাৎ তাকে আরেকটা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

মামলার নথিপত্রে দেখা গেছে, সালমান এফ রহমান এভাবে মুনিরকে একের পর এক মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেন। ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল শফিউল্লাহ আল মুনিরের নামে কাফরুল থানায় আরও একটি মামলা করা হয়। মামলা নং- ৬/৯৪। ওই মামলার বাদী নিজেই বলেছেন, তিনি মুনিরকে চেনেন না, তার নামে তিনি মামলাও করেননি। এই মামলার ঠিক ১ মাস ৫ দিন পর ১১ মে মিরপুর মডেল থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ২০(৫)২১। এ মামলায় পুলিশের তদন্তে পাওয়া যায়- বাদী যে ঠিকানা দিয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ভুয়া। এই নামে কোনো বাদীকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবং বাদীর যে নাম ও ঠিকানা প্রদান করা হয়েছে তাও সম্পূর্ণ মিথ্যা। এ মামলা থেকেও মুনিরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এই মামলায় জামিন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রমনা থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ২৯। তারিখ ২৪ এপ্রিল ২০২১। এই মামলা থেকেও পুলিশ মুনিরকে অব্যাহতি দেয়।

রমনা থানার মামলায় মুনিরকে ২ দিনের রিমান্ডে এনে ৫টি গাড়ি ও দলিলপত্রসহ বেশকিছু চেক নিয়ে যাওয়া হয়। এ বিষয়ে মুনির বলেন, ১৮ ও ১৯ মে রিমান্ডে এনে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে রমনা থানা থেকে চোখ বেঁধে বের করেন তৎকালীন ওসি মনিরুল। এ সময় সালমান এফ রহমানের সহযোগী জয়ন্ত কুমার রায়ও সঙ্গে ছিলেন। সাবেক স্ত্রী জাকিয়া তাজিন বিভিন্ন সময়ে দিকনির্দেশনা দিতেন জয়ন্তকে, সেগুলো পুলিশ দিয়ে বাস্তবায়ন করা হতো। পুলিশ তাকে নিয়ে বাসা ও অফিসে নিয়ে ৫টা গাড়ির চাবি, সব দলিলপত্র, ব্যাংকের চেকবই নিয়ে যায়।

২০২১ সালের ২৪ মার্চ শেরেবাংলা নগর থানায় মুনিরের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ৪৩। এই মামলারও বাদী পায়নি পুলিশ। একই বছরের ১৯ মে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় আরেকটি মামলা করা হয়। মামলা নং ৩৬(৫)২১। এই মামলারও বাদীর নাম-ঠিকানা সঠিক পায়নি পুলিশ। তারপরও সালমান এফ রহমানের চাপে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়। সিআইডি সার্বিক তদন্তের পর ফাইনাল (চূড়ান্ত রিপোর্ট মিথ্যা) রিপোর্ট আদালতে দাখিল করে। ওই রিপোর্টে বলা হয়-ব্যবসায়িক ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মুনিরের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সালমান এফ রহমানের ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ মামলা নং- ৪/২৮৯। ২০২১ সালের ৩ অক্টোবর গুলশান থানায় মামলাটি করা হয়। এই মামলায় অভিযোগ করা হয় ২০২০ সালের ৬ জুন বাদীকে পিস্তল ধরে মেরে ফেলার হুমকি দেন। অথচ পিস্তল ধরে হুমকি দেওয়ার দিনক্ষণ দেওয়া হয় তখন মুনির ছিলেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ কারাগারে বন্দি। এই মিথ্যা মামলায় সালমান এফ রহমানের সরাসরি নির্দেশনায় মুনিরের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়। একই বছর ৮ আগস্ট মুনিরের নামে গুলশান থানায় আরেকটি মামলা দেয়। মামলা নং ২৮। এই মামলার তদন্ত দেওয়া হয় সিআইডিকে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রতিবেদন দিয়ে আদালতকে জানান, ‘মুনিরের নামে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আসামিরা মুনিরকে চেনে না এবং বাদীও মুনিরকে চেনে না। তাই এই মামলা থেকেও মুনিরকে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’

একের পর এক মিথ্যা মামলায় মুনিরকে নির্যাতন ও হয়রানির কারণে তার বড় ভাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর নৌপুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শফিকুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে-‘মিথ্যা এবং ভুয়া পরিচয় দিয়ে মুনিরের নামে মামলা করা হয়েছে যার সবই ভুয়া।’

অভিযোগের বিষয়ে জাকিয়া তাজিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। সালমান এফ রহমানকে গ্রেফতারের পর থেকে তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। গুলশান ১-এর ১২৩ রোডের ৩৭নং বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। বাড়িটিতে ৭ হাজার স্কয়ার ফিটের ট্রিপলেক্স অংশের মালিক ছিলেন শফিউল্লাহ আল মুনির। তাজিন এই বাড়িটির মালিকানাও নিজের নামে নিয়ে গেছেন।

উল্লেখ্য, শফিউল্লাহ আল মুনির ওই সময়ে বাংলাদেশ সাইক্লিং ফেডারেশনের চেয়ারম্যান, এশিয়ান হকির ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম