একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিএমপির নবনিযুক্ত কমিশনার
অপকর্মে জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা
সিরাজুল ইসলাম ও ইমন রহমান
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘিরে সংঘর্ষ-সহিংসতায় পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়েছিল। প্রাণভয়ে পালিয়ে ছিলেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা। এরই মধ্যে ৯৯ শতাংশ পুলিশ সদস্য কাজে ফিরেছেন। তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনাই এ মুহূর্তের মূল চ্যালেঞ্জ। বৃহস্পতিবার দুপুরে যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) নবনিযুক্ত কমিশনার মো. মাইনুল হাসান। তিনি বলেন, থানা পুলিশের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে শুরু হতে আরও ১ মাস সময় লাগবে। সাম্প্রতিক সহিংসতায় পুলিশের ৭৫ ভাগ ইউনিটের অস্ত্র মিসিং বলে তিনি জানান। আরও জানান, পুলিশে এমন পরিস্থিতি কখনো আসেনি। বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। অপকর্মে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, আসাদুজ্জামান এবং যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারসহ কয়েকজন এখনো কাজে ফেরেননি। তারা কোথায় আছেন, সে বিষয়ে ডিএমপির কাছে কোনো তথ্য নেই।
কমিশনার বলেন, ডিএমপির ৫০টি থানার মধ্যে ২২টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পুলিশের মনোবল একেবারে ভেঙে গিয়েছিল। অনেকেই আত্মগোপনে ছিলেন, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন, কাজে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই চেষ্টা করি, তাদের মনোবল বৃদ্ধি করার, যাতে ভয় না পেয়ে কাজে ফিরে আসেন। তাদের ১১ দফা দাবি আদায়ে কর্মবিরতিতে ছিল। আমরা রাজারবাগ ও মিরপুর পুলিশ লাইনসহ, বিভিন্ন পুলিশ স্টেশনে গিয়েছি। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি। যৌক্তিক দাবিগুলো মেটানোর আশা দিয়েছি। নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়-এটলিস্ট থানায় আসতে যেন তারা ভয় না পান। এটি খুব দ্রুত করা হয়েছে। এতে তাদের আস্থা বেড়েছে, থানায় এলে কেউ তাদের মারধর করবে না, ক্ষতি করবে না। ফলে তারা থানায় আসতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে তাদের দাবির বিষয়ে আলোচনায় একটি সমাধান হয়ে যায়। একদিকে সিকিউরিটি লেভেল রেইজ (নিরাপত্তা স্তর বৃদ্ধি) হয়েছে, থ্রেট লেভেল কমে গেছে। এতে পুলিশ সদস্যরা মনে করেছেন আর কর্মবিরতিতে গিয়ে দরকার নেই। যেহেতু আমরা ডিসিপ্লিন ফোর্স-নিয়মনীতি আছে সেহেতু কাজে যোগ দিতে বলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যরা চিন্তা করেছেন, আর কর্মবিরতিতে যাওয়ার দরকার নেই। আমার ধারণা ৯৯ শতাংশ সদস্য কর্মে ফিরে আসছেন।
কমিশনার মাইনুল হাসান বলেন, অনেক স্থানে আমাদের অবকাঠামো পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক স্থানে ভাঙচুর হয়েছে। অস্ত্র নিয়ে গেছে। এর মধ্যে যেখানে অল্প ড্যামেজ হয়েছে সেগুলো মাসখানেকের মধ্যে পুরোদমে কার্যক্রম চালু করব। আর যেগুলো বেশি ড্যামেজ হয়েছে সেগুলো, পার্শ্ববর্তী অন্য ভবনে পুলিশি সেবা চলছে। যানবাহনের ক্ষেত্রে আমরা রি ডিস্ট্রিবিউট করে দেব। যে থানায় সব পুড়ে গেছে সেখানে অন্য পার্শ্ববর্তী থানা থেকে বা অন্য জায়গা থেকে যানবাহন এনে দেব যাতে ন্যূনতম চলতে পারে। মিসিং আর্মস আমরা হিসাব করেছি। বিভিন্ন জায়গাতে যেমন সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব, ফায়ারব্রিগেডে মিসিং অস্ত্র জমা পড়েছে। আমরা মিসিং লিস্ট ও রিকভার লিস্ট মিলিয়ে দেখব। কোনো কোনো জায়গাতে থানা পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখানকার অস্ত্র হয়তো কোথাও জমা পড়েছে। আমাদের কাছে লিস্ট আছে। আমরা মিলিয়ে দেখছি, এটি একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। এই মুহূর্তে অস্ত্র মিসিংয়ের সুনির্দিষ্ট তথ্য বলা যাচ্ছে না। আমাদের ৭৫ ভাগ ইউনিটের অস্ত্র মিসিংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো উদ্ধারে দ্রুত কাজ চলছে। আমাদের রিকভার টিম ১৪৩টি শটগান, ৪৩টি রাইফেল, ৩৪টি পিস্তল, একটি এসএমজি ও এলএমজি রিকভার করেছে। এছাড়া প্রায় ১৭ হাজার অ্যামুনিশন ও ৩ হাজার গ্যাসগান রিকভার করা হয়েছে। উদ্ধার কাজ চলমান। আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে অনুরোধ করেছি, কারও কাছে অস্ত্র থাকলে নিকটস্থ থানায় অথবা অন্য কোনো বাহিনীর কাছে জমা দিয়ে আসেন।
পুলিশের বৃহৎ ইউনিটের প্রধান মাইনুল হাসান বলেন, মনোবল বৃদ্ধির জন্য সদস্যদের মোটিভেশনাল অ্যাড্রেসিং করা, তাদের কর্মের পরিবেশ, বাসস্থান পর্যায়ক্রমে ভালো করা হবে। একই সঙ্গে মনোবল বৃদ্ধিতে আমাদের নিজস্ব কিছু কৌশল আছে। এছাড়া শিক্ষার্থী এবং জনগণকে বলব তারা যেন পুলিশকে ওয়েলকাম জানান। একটা পর্যায়ে কিন্তু মানুষই চেয়েছেন পুলিশ মাঠে নামুক। সমাজ থেকে যদি পুলিশের প্রতি সাপোর্ট আসে তাহলে পুলিশের মনোবল আরও দ্রুত ভালো অবস্থানে আসবে।
ডিএমপির পুলিশ প্রধান বলেন, সারা দেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অনেক হতাহতের ঘটনা আছে। সেহেতু মানুষের একটি স্বাভাবিক ক্ষোভ তো আছেই। এছাড়া পুলিশ সার্ভিস দিতে গিয়ে সব সদস্য সমান আচরণ করেন না। মানুষ ফ্রি থাকতে চান। কিন্তু পুলিশ যখন কিছু নিষেধ করে তখন মানুষ ভাবে কেন নিষেধ করবে। আইন প্রয়োগ করতে গেলে এমনটা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিক্ষোভ দমাতে পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এক্ষেত্রে কোনো কোনো পুলিশ সদস্য অপেশাদার কাজে জড়িত ছিলেন।
পুলিশের যারা অপকর্মে জড়িত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশের প্রতিটি কাজ আইন ও বিধি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কেউ যদি আইন বিধি ভঙ্গ করে ওভার অ্যাকশন নেন তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ছুটিতে থাকা ছাড়া আমাদের প্রায় সবাই কাজে ফিরেছেন। উপরের স্তরের অনেকের বদলির আদেশ আছে। যারা বদলি হয়েছেন, তাদের অনেকে বদলির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে বেশিরভাগই কাজে ফিরেছেন। যারা ফেরেননি পলাতক দেখিয়ে তাদের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিএমপির পুলিশ কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান, হারুন অর রশীদ এবং বিপ্লব কুমার সরকারদের বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। হয়তো কোথাও আছেন তারা। নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা শান্তিশৃঙ্খলা মেইনটেন করে চলেন। কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজে অংশ নেবেন না। আমরা সব সময় আপনাদের সাপোর্ট চাই। পুলিশি পূর্ণাঙ্গ সেবা পেতে একটু সময় লাগবে। সে পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধারণ করুন। যে যেখানে আছেন সবাই আইন মেনে চলুন।