Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জনবল সংকট, নেই লজিস্টিক সাপোর্ট

শেকলবন্দি ই-রেজিস্ট্রেশন নেই কোনো সংস্কার

অধরা রেজিস্ট্রেশন বিভাগ (শেষ)

Icon

বিএম জাহাঙ্গীর

প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শেকলবন্দি ই-রেজিস্ট্রেশন নেই কোনো সংস্কার

রেজিস্ট্রেশন বিভাগ অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানারকম হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও এ সেক্টরে বিদ্যমান সমস্যাও কম নয়। ই-রেজিস্ট্রেশন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে জমি রেজিস্ট্রি আজও শুরু হতে পারেনি। সমীক্ষা যাচাইয়ের নামে পরীক্ষামূলক কাজ শুরু হলেও তা বাস্তবে আলোর মুখ দেখেনি। অন্যদিকে পদোন্নতি বঞ্চনাসহ এখানে বছরের পর বছর ধরে চরম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সময়মতো পদোন্নতি না হওয়ায় অনেকে হতাশ ও সংক্ষুব্ধ। নকলনবিশদের মানবেতর জীবনযাপন সত্যিই বিস্মিত হওয়ার বিষয়। এছাড়া সবকিছু ছাপিয়ে নানারকম আইনি জটিলতার মারপ্যাঁচে শুধু সেবাপ্রার্থীরাই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন না, সাবরেজিস্ট্রারদেরও নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। এজন্য রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টকে যুগোপযোগী করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের কাছে জোরালো দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, সময়মতো পদোন্নতি না হওয়ায় ভুক্তভোগী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। কর্মচারীদের প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করে আইজিআর অফিস থেকে সরাসরি নিয়োগ দিয়ে স্থায়ী পদ পূরণ করা হয়। ফলে পদোন্নতি প্রত্যাশীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এছাড়া নকলনবিশদের পারিশ্রমিক সময়মতো পরিশোধ করা হয় না। প্রাপ্য অর্থ যথাসময়ে ছাড় না করায় প্রায় সময় নকলনবিশদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। সারা দেশে সাবরেজিস্ট্রার পদও অনেক শূন্য রয়েছে। যে কারণে অনেক স্থানে এক স্টেশনের সাবরেজিস্ট্রারকে দিয়ে দুই স্টেশনের কাজ করানো হয়। এত করে জমির ক্রেতা ও বিক্রেতাকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে জেলা রেজিস্ট্রার পদে সময়মতো পদোন্নতি হয় না। গত মার্চ মাস থেকে এ সংক্রান্ত নথি আইন মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। অতীতে এ পদোন্নতির জন্য নানাভাবে তদবির করতে হয়েছে। চেষ্টা-তদবির ছাড়া স্বাভাবিকভাবে পদোন্নতি হয় না। সাবরেজিস্ট্রারদের অনেকে অভিযোগ করে বলেন, তাদের পদটি এক ধরনের ব্লক পদে পরিণত হয়েছে। এক যুগ চাকরি করেও পদোন্নতি হয় না। এছাড়া এখানে সৎ, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের মূল্যায়ন হয় না। যারা সৎ ও চৌকশ কর্মকর্তা তাদের অনেককে রাজধানী ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রাইজপোস্টিংয়ে কখনো পদায়ন করা হয় না। তদবির করার কেউ না থাকায় সব সময় তাদের ডাম্পিং পোস্টিং দিয়ে ঢাকার বাইরে মফস্বলে ফেলে রাখা হয়। কেউ আবার চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার দ্বৈতনীতি নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেন, জেলহাজতে যাওয়ার পর কাউকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে ফেলে রাখা হয়েছে, আবার কারও বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে কাজে ফেরানো হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন কেউ ফৌজদারি অপরাধে একবার জেলে গেলে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করতেই হবে। এ সংক্রান্ত বিধিতে এটি সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।

সাবরেজিস্ট্রারদের অনেকে জানান, রেজিস্ট্রেশন আইনে অনেক অস্পষ্টতা আছে। যে কারণে তাদের পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি অহেতুক তাদের আসামি করে মামলাও করা হয়। অথচ আইনে যেভাবে প্রটেকশন দেওয়া আছে সেটি অনুসরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা নয়। এছাড়া তারা জানান, রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে বেশকিছু আইনি অস্পষ্টতা আছে। যেমন-সাবকবলা ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দলিল করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও বায়না, হেবা, দান, হেবাবিল অ্যাওয়াজ, অ্যাওয়াজ বিনিময়, বণ্টননামা এবং বন্ধকি দলিলের ক্ষেত্রে কী কী কাগজপত্র লাগবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। এ কারণে প্রায় সময় পক্ষগণের মধ্যে বা দলিল লেখকদের সঙ্গে প্রায়ই তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সাবরেজিস্ট্রারদেরও নানান ঝামেলা ফেস করতে হয়।

দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় সাবরেজিস্ট্রার প্রয়োজন মনে করলে প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান চালাতে পারেন না। যেমন-আসলে এই ব্যক্তি জমির প্রকৃত মালিক কিনা, জাতীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি সঠিক কিনা, নামজারি ও খাজনা খারিজ আদৌ সঠিক না জাল এবং প্রকৃতপক্ষে কত টাকা মূল্যে কেনাবেচা হয়েছে-এমন সব অনুসন্ধান করতে চাইলেও সাবরেজিস্ট্রার করতে পারেন না। তাকে ম্যানুয়ালি কাগজপত্র দেখে এবং শনাক্তকারীকে বিশ্বাস করে তাৎক্ষণিকভাবে রেজিস্ট্রি করে দিতে হয়।

এছাড়া এনবিআর-এর ভ্যাট-ট্যাক্সসংক্রান্ত আইনগুলোও স্পষ্ট নয়। যেমন- কোন দলিলে ভ্যাট-ট্যাক্স লাগবে, কোন দলিলে লাগবে না তা নিয়ে বেশ জটিলতা দেখা দেয়। যেমন-বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিক্রি বলতে কী বোঝায় এটি এনবিআর-এর গেজেটে সুস্পষ্টভাবে বলা নেই। ফলে কোন বিক্রিটা বাণিজ্যিক কিংবা বাণিজ্যিক হবে না তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এখানে একটু ভুল হলে সরকার কিংবা ক্রেতার উভয় পক্ষে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

তারা জানান, রেজিস্ট্রেশন বিভাগের দলিল রেজিস্ট্রি সংক্রান্ত ইনডেস্ক বা সূচিপত্র ডিজিটাল না হওয়ার কারণে অনেক সমস্যা হচ্ছে। সবকিছু ঠিকঠাক ম্যানুয়ালি যাচাই করা কঠিন। এ কারণে একই জমি বারবার বিক্রি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। জাল-জালিয়াতি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রেশন আইনের ৮৬ ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রারিং কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে কোনো দলিল করতে না চাইলে অথবা করলে তার জন্য তিনি দায়ী হবে না এবং তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা মোকদ্দমা রজু করা যাবে না। ১৮৫০ সালের প্যানাল কোডের ৭৭ ধারা মোতাবেক বিচারকদের যেরূপ নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে একইভাবে সাবরেজিস্ট্রারদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে ৮৬ ধারা প্রণয়ন করা হয়। এছাড়া ১৮৫০ সালের জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্ট ১৮-এর সেকশন ৭৭ অনুযায়ী সাবরেজিস্ট্রারদের কর্মকাণ্ডকে বিচারিক কর্মকাণ্ড হিসাবে গণ্য করা হয়। সাবরেজিস্ট্রাররা বলেন, এই ধারা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রায় সময় হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমা ফেস করতে হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র সার্ভারের সঙ্গে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ না থাকায় টিপ-সই বা ব্যক্তির প্রকৃত পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে প্রায় সময় জাল দলিল সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যদিও এ বিষয়ে সাবরেজিস্ট্রারের কার্যত তেমন কিছু করা নেই। সাবরেজিস্ট্রাররা জানান, তাদের কন্টিনজেন্সি খরচ পর্যাপ্ত নয়। ফলে অফিসের দৈনন্দিন খরচ মেটানো সম্ভব হয় না।

বিভিন্ন তদন্ত সংস্থা যেমন-দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং জেলা প্রশাসকের দপ্তরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে দলিল বা সম্পদ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয় দলিল ও কাগজপত্র চেয়ে প্রায় প্রতিদিনই সাবরেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি আসে। কিন্তু ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে জবাব দিতে গেলে যৌক্তিক সময় প্রয়োজন। অথচ সেভাবে সময় দেওয়া হয় না। যে কারণে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের রুটিন কাজ ঠিকঠাক করতে অনেক সমস্যা হয়। কেননা এমনিতে কাজের তুলনায় জনবল খুবই কম। বিশেষ করে যেসব সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দিনে কমপক্ষে ৫০টি দলিল রেজিস্ট্রি হয় সেখানে এ ধরনের সমস্যা খুবই প্রকট।

রাজধানীর তেজগাঁও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স ভবনের রেকর্ড রুমসহ সারা দেশে যেসব রেকর্ড রুম আছে সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় পুরাতন ও মূল্যবান রেকর্ড তথা বালাম বহি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া অনেক সময় মামলার প্রয়োজনে বালাম বহি জব্দ করে নিয়ে গেলে সেটি থানা কিংবা আদালতের মালখানায় যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না।

এদিকে রেজিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টে ম্যানুয়াল পদ্ধতির নানান জটিলতা দূর করে সেবার মান বাড়ানোর জন্য ২০২০ সালে দলিল রেজিস্ট্রিকে অটোমেশনে রূপ দিতে একটি সমীক্ষা যাচাইয়ের আওতায় আনা হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সে সময় পাইলট স্কিম হিসাবে ১৭টি সাবরেজিস্ট্রি অফিসকে নিয়ে এর পরীক্ষামূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এ তালিকায় ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও, গুলশান ও সাভারসহ রূপগঞ্জ, কসবা, চিলির বন্দর প্রভৃতি অফিস সংযুক্ত করা হয়। সে সময় ম্যানুয়ালি দলিল রেজিস্ট্রি হলেও পৃথকভাবে সাদা কাগজে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দলিল সম্পাদন করা হতো। এ পদ্ধতিতে প্রথমে দলিল লেখক ডিজিটাল ফরমেটে দলিল লিখে তা কেরানির কাছে নির্দিষ্ট কোডে পাঠাবেন। অফিসের প্রধান সহকারী বা কেরানি তা ভালোভাবে যাচাই করে পাঠাবে সাবরেজিস্ট্রারের কাছে। সাবরেজিস্ট্রার জমির শ্রেণি, জমির মূল্য, নামজারি জমাভাগ এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভারে ঢুকে পরিচয়পত্র ও স্বাক্ষর যাচাই করবেন। সবকিছু ঠিক থাকলে সাবরেজিস্ট্রার ওকে লিখে ক্রেতার মুঠোফোনে একটি কোর্ড ও দলিল রেজিস্ট্রির তারিখ নির্ধারণ করে পাঠাবেন। সে অনুযায়ী রেজিস্ট্রির সময় বিক্রেতা ও ক্রেতাকে ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ দিতে হবে। এরপর একই দলিল ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রিন্ট করে পরদিন ক্রেতাকে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া পৃথকভাবে দলিল ম্যানুয়ালি বালাম বইয়ে সংরক্ষণ করা হবে। সাবরেজিস্ট্রাররা মনে করেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে এক ছাতার নিচে দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব হলে সবকিছু সহজ হয়ে যেত। জাল-জালিয়াতি ও হয়রানি শূন্যের কোঠায় নেমে আসত। কিন্তু সমীক্ষা যাচাই শেষ হওয়ার পর এ সংক্রান্ত প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি। তাদের মতে, এক ধরনের শেকলবন্দি হয়ে পড়েছে কাঙ্ক্ষিত ই-রেজিস্ট্রেশন। তবে তারা মনে করেন, নিশ্চয় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম