সরকার বদলের প্রভাব বিআইডব্লিউটিএতে
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বড় পরিসরে বদলির সিদ্ধান্ত
লক্ষ্য রোষানল থেকে বাঁচানো ও সিন্ডিকেট ভাঙা
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে বদলে গেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ভেতরকার চিত্র। আওয়ামী লীগপন্থি সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতা গা-ঢাকা দিয়েছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারা কর্মস্থলে যোগ দেননি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিনই রাজধানীর মতিঝিলে অবস্থিত বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশপথে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি ভেঙে ফেলা হয়।
সিবিএ কার্যালয় বুঝে নিয়েছে বিএনপিপন্থি কর্মচারীরা। আধিপত্য বিস্তারে তৎপরতা বেড়েছে বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাদেরও। এদিকে পটপরিবর্তন পরিস্থিতিতে ৩-৪ বছরের বেশি সময় ধরে একই পদে থাকা সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধাপে ধাপে বদলির নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বন্দর কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা নিজেদের অনিরাপদ মনে করবেন, তাদেরকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে। ঢাকা নদী বন্দর কর্মকর্তাকে গত বৃহস্পতিবার বদলি করে সদর দপ্তরে নেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম কমিয়ে আনা, নতুন প্রকল্প না নেওয়া, আপাতত নীতি-নির্ধারণী কার্যক্রম গ্রহণ না করে শুধু রুটিন কাজ চালানোসহ বেশ কিছু বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
তবে ঘাট ইজারা, উন্নয়ন কার্যক্রম ও জনবল নিয়োগে অনিয়ম এবং বিভিন্ন প্রকল্পের টেন্ডার কারসাজির ঘটনা তদন্তের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রসঙ্গত এ সংস্থাটিতে বর্তমানে পাঁচ হাজার চারশ’র বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা শনিবার যুগান্তরকে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এর মধ্যে কমকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও বদলির বিষয় রয়েছে। সবকিছু এখনই বলা যাচ্ছে না। সময় হলে দেখতে পাবেন।
অনিয়মের তদন্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসলে আগেও ব্যবস্থা নিয়েছি, এখনও নেব। এটা চলমান প্রক্রিয়া।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাটির নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিরোধীদের রোষানল থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাঁচানো, বিআইডব্লিউটিএ’র সিন্ডিকেট ভাঙা ও সংস্কার কার্যক্রম দৃশ্যমান করতে এসব নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তারা আরও বলেন, সংস্থাটির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও ঠিকাদারদের সঙ্গে মিলেমিশে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, এমন বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় বা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে যে ঠিকাদারদের মনোনীত করে দেওয়া হতো তাদেরকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার গোপন আয়োজন করেছেন তারা। টানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে একই পদের রয়েছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
এসব কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি প্রায় সাড়ে তিনশ’ ঘাটপয়েন্ট ইজারা দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওইসব ঘাটের ইজারা পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এমন অবস্থায় অনেক বন্দর কর্মকর্তা নিজ কর্মস্থলে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিনই তিনি ও তার বোন শেখ রেহানা পালিয়ে ভারতে চলে যান। তার আকস্মিক পদত্যাগে রাজনৈতিক অঙ্গনের পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পালাবদল ঘটে। এর মধ্যে অন্যতম বিআইডব্লিউটিএ।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেছে, বিআইডব্লিউটিএ ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ভাঙা। ভবনে প্রবেশ পথে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য যেখানে ছিল ওই স্থান পুরোপুরি পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। সিবিএ অফিসে বিএনপিপন্থি কয়েকজন কর্মচারী বসে আছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সরকার পতনের দিনই বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভেঙে ফেলা হয়। ভবনের দোতলায় লাইব্রেরিতে বঙ্গবন্ধু কর্নার তছনছ করা হয়েছে। বিভিন্ন রুম থেকে শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি ফেলে দেওয়া হয়েছে।
ওইদিনই গা-ঢাকা দেন সিবিএ সভাপতি আবুল হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার হুসাইন ও কার্যকরী সভাপতি মো. আকতার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ব্যবহার করে সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে জনবল নিয়োগ, বদলি ঘাট ইজারা, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বছরের পর বছর নির্বাচন ছাড়াই পদ দখল করে রাখার অভিযোগও রয়েছে এ কমিটির বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে সভাপতি আবুল হোসেনকে ফোন করে বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সাধারণ সম্পাদক ছরোয়ার হুসাইন বলেন, আমি শারীরিক অসুস্থতার কারণে অফিসে যাইনি। তবে এ সপ্তাহে যাব। আমি নিরাপত্তা পেলে অফিস করব। তবে সিবিএ নিয়ে এখন আর ভাবছি না। কার্যকরী সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমি গন্ডগোল (ছাত্র আন্দোলন) শুরুর আগ থেকেই ছুটিতে আছি। এ কারণে যাইনি। তবে এ সপ্তাহে যাব। তিনি বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর রাজনীতি করার ইচ্ছে নেই। আর সিবিএ করব না বলে সবাইকে বলে দিয়েছি।
নীতিগত কিছু সিদ্ধান্ত : জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের একদিন পর করণীয় বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা, সদস্য (পরিকল্পনা ও পরিচালন) মো. সেলিম ফকির, সদস্য (প্রকৌশল) মোহাম্মদ মনোয়ার উজ জামান ও সদস্য (অর্থ) মো. রফিউল হাসাইন। ওই বৈঠকে বেশ কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন তারা। এগুলোর মধ্যে আছে যেসব কর্মকর্তা ৩-৪ বছর একই পদে রয়েছেন তাদেরকে এবং কর্মচারীদেরও বদলি করা হবে।
কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা থাকবে। চলতি সপ্তাহ থেকে ধাপে ধাপে বদলি আদেশ জারি শুরু হবে। শুরুতেই প্রকৌশলীদের বদলি করা হবে। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা জানান, একবারে বড় ধরনের বদলি আদেশ জারি হলে কার্যক্রম পরিচালনায় স্থবিরতা আসতে পারে, তাই ধাপে ধাপে করা হবে। এছাড়া বন্দর কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, তাদের ওই জায়গা থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে।
নিরাপত্তাহীনতার কারণে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা নদী বন্দর কর্মকর্তা মো. আলমগীর কবীরকে বদলি করে সদর দপ্তরে আনা হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর সদরঘাট দখল নিয়েছে বিএনপিপন্থিরা।
অন্যান্য নীতিগত সিদ্ধান্তের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার থেকে নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত চলমান প্রকল্পগুলোতে কোনো ধরনের অর্থ ব্যয় করা হবে না। নতুন করে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হবে না। চলমান প্রকল্পগুলোতে যতটা সম্ভব ব্যয় কমিয়ে আনার প্রস্তাব তৈরি করা হবে।
অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা বন্ধ থাকবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রমে রাশ টানা হবে। আওয়ামী লীগপন্থি কয়েকজন ঠিকাদার, যারা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের কার্যাদেশ বাতিল করার পরিকল্পনা রয়েছে।