Logo
Logo
×

শেষ পাতা

অর্থনীতিবিদদের অভিমত

আস্থা ফেরানো ও ডলারের জোগান বাড়ানো জরুরি

দুর্নীতি, টাকা পাচার, হুন্ডি বন্ধ হলে পরিস্থিতি উন্নয়নে সহায়ক হবে -ড. আহসান এইচ মনসুর

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আস্থা ফেরানো ও ডলারের জোগান বাড়ানো জরুরি

দেশের সার্বিক অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সবার আগে মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সব উদ্যোক্তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে হামলা-মামলা।

একই সঙ্গে বাজারে ডলারের জোগান বাড়াতে হবে। চাহিদা অনুযায়ী নিশ্চিত করতে হবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ। পাশাপাশি সৃষ্টি করতে হবে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ। আর ঋণের সুদের হার নামিয়ে আনতে হবে সহনীয় পর্যায়ে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক করতে নতুন সরকারের করণীয় সম্পর্কে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা শনিবার যুগান্তরের কাছে এসব পরামর্শ দিয়েছেন।

তাদের আরও অভিমত-দেশের অর্থনীতি আগে থকেই বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। নতুন সরকারের প্রেক্ষাপটে এখন চ্যালেঞ্জের সংখ্যা আরও বাড়ল। এখনকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা।

কারখানার নিরাপত্তা জোরদার করে উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করা। পাশাপাশি ভেঙে পড়া সরবরাহ ব্যবস্থাও দ্রুত স্বাভাবিক করতে হবে।

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে উৎপাদন যেমন বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যও ব্যাহত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা। যে কারণে পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় ধীরে ধীরে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে। পণ্যের দাম কিছুটা কমতে শুরু করেছে। তবে পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থা এখনও স্বাভাবিক হয়নি।

বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কনটেইনার জট লেগে গেছে। নিরাপত্তার কারণে উদ্যোক্তারা পণ্যের ডেলিভারি নিচ্ছেন কম। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমদানি-রপ্তানিতে।

সূত্র জানায়, দেশে ডলারের সংকট এখনো প্রকট। ডলারের দামকে কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দামে কোথাও ডলার মিলছে না। ফলে আমদানির এলসি খোলা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিশেষ করে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিনিয়োগ, শিল্পের বিকাশ ও কর্মসংস্থান। সাম্প্রতিক আন্দোলনের নেপথ্যেও কাজ করেছে অর্থনৈতিক সংকট। ২০১২ সাল থেকে আর্থিক খাতে বড় বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর একের পর এক আরও বড় ঘটনা ঘটেছে। এতে আর্থিক খাতে কর্মসংস্থানের গতি কমে যায়।

২০১৫ সাল থেকে দেশের অর্থনীতিতে ভর করেছে মন্দা। এ কারণে বেসরকারি খাতের বিকাশ কমে যায়। ফলে এ খাতেও কর্মসংস্থান কমে যায়। এর মধ্যে করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকে বেসরকারি খাতে ভয়াবহ মন্দার কারণে কর্মসংস্থান বলতে গেলে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

২০২২ সাল থেকে বৈশ্বিক মন্দার কারণে এ খাতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ওই সময়ে বেসরকারি খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়ায় বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। এদের বেশিরভাগই কর্মে ফিরে যেতে পারে। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৯৫ শতাংশই হচ্ছে বেসরকারি খাতে।

সরকারি খাতে হচ্ছে মাত্র ৫ শতাংশ। মন্দা মোকাবিলায় সরকারি খাতেও কর্মসংস্থান কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। কোটার কারণে মেধাবীরা সরকারি চাকরিতেও প্রবেশ করতে পারছিল না। যে কারণে তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, তরুণদের প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে আগে অর্থনীতিকে গতিশীল করে এখন বিনিয়োগ বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বিনিয়োগ ও ঋণের প্রবাহ বাড়িয়ে বড় শিল্পের পাশাপাশি কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে চাঙা করতে হবে।

বেসরকারি খাতে এসব ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। এজন্য সরকার শিক্ষিত বেকারদের বাংলাদেশ কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), এমএমই ফাউন্ডেশন, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তরসহ আরও যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্পের উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে পারে। যারা কর্মসংস্থানে বড় ভূমিকা রাখবে।

এ জন্য বিশেষ প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। এদের কম সুদে ঋণের জোগানও দিতে হবে। আইনি কাঠামো সহজ করে ব্যবসার সহজ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে। মানুষের আয় বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা হলেও কমবে।

এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, নতুন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আগে থেকে চলা সংকটের কারণে খুব শিগগির অর্থনীতিকে স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। তবে নতুন অনিয়ম, দুর্নীতির টাকা পাচার, হুন্ডি বন্ধ হলে পরিস্থিতি উন্নয়নে স্বাভাবিক হবে। এখন অর্থনীতিতে গতিশীল করতে হলে সবার আগে আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়া ও পণ্যের দাম বাড়ায় আগামী মাসে মূল্যস্ফীতির হার আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ডলারের দামও বাড়তে পারে। এ কারণে মূল্যস্ফীতিতে চাপ আরও বাড়তে পারে। এখন রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। হুন্ডি বন্ধ করতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রাথমিকভাবে সরকারি খাতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া যায়। এর মধ্যে সরকারি খাতের শূন্য পদগুলোতে নিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকারি খাতের অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোতে জনবল সংকট যেমন আছে, তেমনি অনেক ইউনিট বন্ধ রয়েছে। সেগুলোকে সচল করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

বিসিকের শিল্প নগরীগুলোতে অনেক শিল্প প্লট খালি বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে আছে। বন্ধ প্রতিষ্ঠান চালুর পাশাপাশি খালি প্লটগুলো বরাদ্দ দিয়ে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এতে একদিকে জমির অপচয় কমবে। অন্যদিকে দ্রুত শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হবে।

বড় শিল্প গ্রুপগুলোকে নতুন করে আলাদা ইউনিট স্থাপন করে বা চলমান শিল্প আরও সম্প্রসারণ করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর মাধ্যমে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে অন্যদিকে উদ্যোক্তা তৈরি হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, অর্থনীতিকে চাঙা করা খুব কঠিন হবে। এখন জরুরিভিত্তিতে আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এর জন্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। তখন মানুষের আয় বাড়বে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।

তিনি আরও বলেন আগে থেকে দেশ মূল্যস্ফীতির ফাঁদে পড়ে আছে। এ হার এখনই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তবে এখন পণ্যমূল্য কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেসব খাতে চাঁদাবাজি বা কমিশন বাণিজ্য বা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ডলারের জোগান বাড়াতে হবে। এজন্য রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তাহলে টাকার মান স্থিতিশীল হবে। আমিদানি বাড়ানো যাবে। তখন মূল্যস্ফীতির হার এমনিতেই কমে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলেছেন, রেমিট্যান্স বাড়াতে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। যেসব দেশে বেশি প্রবাসী রয়েছেন ওইসব দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে ব্যাংক সেবা সহজ করতে হবে। যারা হুন্ডি করে তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে যারা হুন্ডিতে টাকা প্রবাসীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দুদিক থেকে হুন্ডিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হুন্ডি কমে যাবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়বে।

ডলার সংকট কাটাতে বকেয়া রপ্তানি আয় দ্রত দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানির মূল্য দেশে না এনে এবং মূল্য কম দেখিয়ে বা ঘোষণার চেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করে ডলার পাচার বন্ধ করতে হবে। একই ভাবে আমদানির আড়ালেও টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে। তাহলে ডলার সংকট কিছুটা হলেও কমে যাবে। দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগে অনেক বছর ধরেই মন্দা চলছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, জরুরিভিত্তিতে এখন কারখানার নিরাপত্তা দিতে হবে। বন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে হবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

ঋণের সুদের হার মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এ হার কমাতে হবে। ব্যাংক থেকে এখন চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। ঋণের জোগান বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক কারণে কোনো উদ্যোক্তা যাতে হয়রানির শিকার না হন সেদিকে নজর রাখতে হবে। সব উদ্যোক্তাকে সমানভাবে কাজের সুযোগ দিতে হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম