স্বাচিপ আউট, ড্যাব ইন
হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণে রাজনীতি সেবাবঞ্চিত রোগীরা
হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন রোগীরা * বিএমএ ছাড়া সব সংগঠন বন্ধ করে দেওয়া উচিত : অধ্যাপক নজরুল ইসলাম
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ড্যাব)।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) অনুসারী অনেক চিকিৎসক আতঙ্কে হাসপাতালে আসছেন না। এ কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না রোগীরা। পাঁচদিন ধরে রাজধানী ছাড়াও বিভাগ ও জেলা পর্যায়ের একাধিক চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে রোগী-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, অনেক রোগী হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরালেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছেন না তারা। যে কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন অসহায় রোগী ও তার স্বজনরা।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ছিল চিকিৎসকদের একমাত্র জাতীয় সংগঠন। বিএমএ-এর প্রতি সব চিকিৎসকের আস্থা ছিল। ১৯৯১ সালে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের উদ্যোগে ড্যাব নামে দলভিত্তিক নতুন একটি সংগঠন তৈরি হয়। এর দুই বছরের মাথায় গঠিত হয় স্বাচিপ।
বর্তমানে বিএমএ, ড্যাব ও স্বাচিপ ছাড়াও জামায়াতপন্থি চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত হয় ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম (এনডিএফ), সাধারণ চিকিৎসকদের স্বতন্ত্র সংগঠন হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ ডক্টরস ফোরাম (বিডিএফ) এবং ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটস (এফডিএসআর)।
এছাড়াও স্বাধীনতা ডেন্টাল চিকিৎসক পরিষদ, স্বাধীনতা হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদ, হোমিওপ্যাথিক ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, স্বাধীনতা দেশজ চিকিৎসক পরিষদ, ইউনানী আয়ুর্বেদিক ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ নামে চিকিৎসক সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের দলাদলিতে রোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা। সরকার বদলের সঙ্গে এর তীব্রতা আরও বাড়ে। কয়েকদিন ধরে সেই অবস্থাই চলছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশ-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মাঝে পরে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী (১৮) নামের এক তরুণ। উন্নত চিকিৎসার জন্য একে একে তিনটি হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। বর্তমানে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) দুই নং ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তার পরিবারের অভিযোগ, কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা পাচ্ছেন না মেহেদী।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা। মেহেদীর বাবা আব্দুল গনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ১৯ জুলাই ছেলের ডান পায়ে গুলি লেগে গোড়ালির হাড় ভেদ করে যায়। প্রথমে তাকে মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। সদ্য বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেখতে আসায় চিকিৎসকরা তাকে ক্যাজুয়ালিটি ২-এ ট্রান্সফার করেন। সপ্তাহে তিনদিন জুনিয়র চিকিৎসকের দেখা পাওয়া যায়। তবে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছু জানেন না বলে জানান।
জানতে চাইলে কর্তব্যরত নার্সরা যুগান্তরকে জানান, মেহেদী হাসপাতাল পরিচালক ডা. শামিমুজ্জামানের অধীনে ভর্তি। পরিচালক স্বাচিপপন্থি হওয়ায় পরিস্থিতির কারণে তিনদিন পর হাসপাতালে আসছেন না। তার অনুপস্থিতিতে জুনিয়র চিকিৎসকরা দেখভাল করলেও বিশেষজ্ঞ সেবাবঞ্চিত হওয়টাই স্বাভাবিক। শুধু মেহেদী নন, কাটা পা নিয়ে এই ওয়ার্ডের জি-৩৮নং শয্যায় ভর্তি আরাফাত হোসেন, জি-৯ নম্বর শয্যার নাদিম হোসেনসহ অনেক রোগীর অভিযোগ, মেডিকেল শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন ও কনসালটেন্ট ছাড়া সিনিয়র ডাক্তাররা আসছেন না।
এমনকি তারা কোন চিকিৎসকের অধীনে ভর্তি, সেটাও জানেন না। বৃহস্পতিবার স্বাচিপ অনুসারী পঙ্গু হাসপাতালের একাধিক সিনিয়র চিকিৎসকের কক্ষ ঘুরে অধিকাংশই তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের কক্ষের সামনে নামফলক ভেঙে ফেলা হয়েছে।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের প্রশাসনিক ইউনিটের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, এতদিন স্বাচিপ চিকিৎসকরা ড্যাব অনুসারীদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে পরিচিতদের বেশির ভাগই স্বাচিপপন্থি অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক। ক্ষমতার পরিবর্তনে এখন তারা কর্মস্থলে আসতে পারছেন না। তাদের অধীনে একাধিক রোগী ভর্তি রয়েছেন। অনুপস্থিতির কারণে এই রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার উত্তর ব্লকের ক্যাথ ল্যাবে (জোন-১) গিয়ে রোগী ও চিকিৎসকদের উপস্থিতি খুবই কম দেখা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাথ ল্যাবটিতে রোগীদের এনজিওগ্রাম, পেস মেকার, রিং পরানো ও শিশুদের হার্টের ছিদ্র বন্ধে ডিভাইস পরানো হয়। ৫ আগস্ট থেকে ল্যাবটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে। বৃহস্পতিবার মাত্র তিন শিশুর হার্টের ছিদ্র বন্ধের ডিভাইস পরানো হয়েছে।
কয়েকজন অপারেশন থিয়েটারের নার্স বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে এই ল্যাবে দৈনিক দশজনের এনজিওগ্রাম করা হতো। গত তিনদিন একজন রোগীও আসেনি। এছাড়া চিকিৎসকরা দিনে চারজনের পেস মেকার বসাতেন। সেখানে গত চারদিন ছয়জন রোগী এসেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) দুজন এসেছেন। মূলত চিকিৎসকদের অনুপস্থিতিতেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ড্যাব বিএনপি এবং স্বাচিপ আওয়ামী লীগের লেজুরভিত্তিক সংগঠন। এর বাইরে চিকিৎসকদের আরও কিছু সংগঠন গড়ে উঠেছে। সংগঠনগুলো মূলত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, চিকিৎসা শিক্ষা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে সব হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিজেদের রাজনৈতিক দলের আধিপত্য এবং প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবি দখলে ব্যস্ত থাকে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উপাসনালয়ের মতো দেখা উচিত। সংগঠনগুলোর কারণে সেই পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। তাই বিএমএ ছাড়া সব চিকিৎসক সংগঠন নিষিদ্ধ করা দরকার বলে মনে করি।