Logo
Logo
×

শেষ পাতা

পুলিশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘পলায়নে’ ক্ষোভ

Icon

মামুন আবদুল্লাহ

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুলিশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘পলায়নে’ ক্ষোভ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে রাজধানীজুড়ে চলমান সংঘাতের ঘটনায় নিহত পুলিশ সদস্যদের সুরক্ষা না দিয়ে ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তাদের ‘পলায়নের’ ঘটনায় ক্ষোভ বিরাজ করছে অধস্তন কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা পুলিশের চাকরি রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন করা, পলায়নকৃত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুত এবং পিএসসির মাধ্যমে এসআই পদে নিয়োগ পদ্ধতি চালু, পুলিশ সদস্যরা মন্ত্রী-এমপির প্রটোকল না দেওয়াসহ বেশকিছু দাবি তুলেছেন। এসব দাবি মানা না হলে কোনো ধরনের প্রশাসনিক কাজে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মঙ্গলবার ও বুধবার বিভিন্ন ব্যাচের পরিদর্শক ও এসআইরা এসব দাবি সংবলিত বার্তা সাংবাদিকদের কাছে পাঠিয়েছেন। এর আগে মঙ্গলবার রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতরের অধস্তন কর্মকর্তারা কর্মবিরতি দিয়ে এসব দাবি জানিয়েছিলেন। তবে কর্মবিরতির বিষয়টি গুজব উল্লেখ করে সব পর্যায়ের সদস্যদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দেশের সব পুলিশ সদস্যকে আজ সন্ধ্যার মধ্যে নিজ নিজ পুলিশ লাইন্স, দপ্তর, পিওএম ও ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম। বুধবার আইজিপি হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ নির্দেশ দেন।

মাঠ পর্যায়ে কাজ করা বেশ কয়েকজন পরিদর্শক ও এসআই যুগান্তরকে অভিযোগে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা হুকুম দিয়ে দায় সারেন। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হলে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার রাজনৈতিক মনোবাসনা বাস্তবায়নের বলি হয়েছেন অধস্তন কর্মীরা। ছাত্র-জনতার মটিভের বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারকে টিকিয়ে রাখার এজেন্ডা নেওয়ায় এমন ঝামেলা হয় অধস্তনদের।

অধস্তন কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ঊর্ধ্বতনরা সরাসরি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসাবে যোগদান করেন। তাদের মামলার তদন্তসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা যেমন থাকে না, তেমনি সার্বিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম থাকে। কিন্তু পদাধিকার বলে তারা সিনিয়র হওয়ায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অধস্তন কর্মকর্তাদের সিনিয়রদের নির্দেশনা মতো চলতে হয়। যার কারণে মাঠ পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশে কাজ করতে ঝামেলায় পড়লে তারা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যান।

গত কয়েকদিনের পুলিশ সদস্য নিহতের বিষয়টি উল্লেখ করে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এ পর্যন্ত পুর্লিশের যারা মারা গেছেন, বেশিরভাগই মাঠ পর্যায়ের কর্মী। যারা হুকুম দিয়েছেন, সেসব ঊর্ধ্বতনরা হুকুম দিয়েই দায় সেরেছেন। ঝামেলা শুরুর পর নিজেরা সেফ জোনে রয়েছেন। থানার ভেতরে আগুন দিয়ে পুলিশ সদস্য মারার সময় সাহায্য চাওয়া হলেও সিনিয়রদের কোনো খোঁজ নেই। এভাবে তো বাহিনী চলতে পারে না। তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে হারুন অর রশীদ, বিপ্লব কুমার সরকার এমনকি ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে জড়িতদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার কথা বলেন। ক্ষুব্ধ এসআই ও পরিদর্শকরা বলেন, ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন না করলে মাঠের কর্মীরা বিপদগ্রস্ত হতেন না। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে না হয়ে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণাধীন চাকরি করতে চান বলে জানান।

পরিদর্শক ও এসআই পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। এক্ষেত্রে এসআই ও কনস্টেবল পদে নিয়োগের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ পদ্ধতি চালু করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, এসআই পদে পিএসসির মাধ্যমে আর কনস্টেবল পদে পুলিশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়োগ চালু করতে হবে। তারা সেনাবাহিনীর নিয়োগ পদ্ধতি উল্লেখ করে বলেন, সেখানে অফিসার হিসাবে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এবং কনস্টেবল হিসাবে নিয়োগ শুরু হয়। পুলিশেও এমন সিস্টেম করলে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে প্রত্যেকের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার সুযোগ থাকবে। এর ফলে সব কর্মকর্তা ও সদস্যের মাঠপর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং পুলিশের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ধারণা থাকবে। অবৈধ আদেশ দিতে তাদের বিবেকে বাধবে এবং পদোন্নতির আশায় সব কর্মকর্তা শতভাগ পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করবে।

পুলিশের বিভিন্ন ব্যাচের সাব-ইন্সপেক্টর ও ইন্সপেক্টরা বিভিন্ন দাবি সাংবাদিকদের কাছে পাঠিয়েছেন। এসব দাবির মধ্যে আন্দোলনে পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনার বিচার নিশ্চিত ও সরকারের অধীনে কাজ না করার কথা জানায়। তাদের দাবির মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীন থেকে রাষ্ট্রপতির অধীনে ন্যস্ত, ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করাসহ স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন।

কোনো এমপি-মন্ত্রীকে প্রটোকল না দেওয়া, দৈনিক ৮ ঘণ্টা ডিউটি, বেশি হলে ওভারটাইম গণনা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মতো দ্রুত পদোন্নতির ব্যবস্থা। নৈমিত্তিক ছুটি বছরে ৬০ দিন করা। কনস্টেবল থেকে এসআই পদে ঝুঁকিভাতা বৃদ্ধি। চলমান হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী পুলিশ কমান্ডিং অফিসারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। উন্নত রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করাসহ বেশকিছু দাবি জানান।

এছাড়া আরও কিছু দাবির মধ্যে- সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্ট পিএসসির অধীনে এবং কনস্টেবল পুলিশ হেডকোয়ার্টারের অধীনে নিয়োগ চালু করা, সাব-ইন্সপেক্টর/সার্জেন্ট পদে বিদ্যমান পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন করে পরিদর্শক পদ থেকে সহকারী পুলিশ কমিশনার পদে ৩০ শতাংশ সরাসরি এবং ৭০ শতাংশ পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ এবং সেটি যথাসময়ে নিশ্চিত করা। এছাড়া কনস্টেবল/নায়েক/এটিএসআই/এএসআই পদোন্নতির ক্ষেত্রে পরীক্ষায় পাশকৃতদের পরবর্তী বছর পুনঃপরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা বাতিল এবং পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে পাশকৃতদের সিনিয়রিটি অনুসরণ করার কথা বলা হয়।

পুলিশের নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম বুধবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে না পারায় অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। অনেকেই নিজ নিজ ইউনিটে নেই। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা নতুন করে সব শুরু করতে চাই। তাই সবাইকে ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ ৮ আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফেরার নির্দেশনা দেন।

এর আগে মঙ্গলবার রাতে রাজারবাগে এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত আইজিপি একেএম শহিদুর রহমান বলেছেন, পুলিশ অবশ্যই বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনী। পুলিশ ছাড়া আসলে এ সমাজ ব্যবস্থা চিন্তা করা যায় না। যে ক্রাইসিসে আমরা পড়েছি সেটি থেকে উত্তরণের চেষ্টা আমরা করছি। আমরা খুব দ্রুত পুলিশের চেইন অব কমান্ড এস্টাবলিস্ট করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, ডিএমপির বিভিন্ন থানা এলাকায় সাধারণ পুলিশ সদস্য নিহত-আহত হয়েছেন, যাদের লাশ বিভিন্ন থানায় পড়ে রয়েছে আমরা তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করে যাচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ লাশ সৎকার করে দাফনের জন্য নিজ নিজ ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরতে বলেন।

অধস্তনদের কর্মবিরতির বিষয়টি গুজব উল্লেখ করে মঙ্গলবার রাতে বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু জনগণের জন্যই কাজ করে। পুলিশ ছাড়া আমরা কোনো সমাজ চিন্তা করতে পারি না। সুতরাং আমাদের পুলিশ সদস্যদের আবারও আমি অনুরোধ করব, আপনারা এসব গুজবে কান না দিয়ে আপনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করবেন। দেশবাসীকে পুলিশকে সহযোগিতার অনুরোধ করেন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম