নিরাপত্তাহীন গণভবনে জনস্রোত, মাছ-মাংসসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট
নেসারুল হক খোকন
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
‘গণভবন’ মানেই নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অনুমতি ছাড়া বাড়িটির ভেতরে তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের ধারেকাছেই যাওয়ার সুযোগ নেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি এই বাড়িটির নিরাপত্তা বাড়ানো হয় কয়েকগুণ। এই নিরাপত্তা বেষ্টনীর ধারাবাহিকতায় মিরপুর রোডের আশপাশ এলাকার মানুষের হয়রানি ছিল চোখে পড়ার মতো। বলতে গেলে গণভবনের আশপাশের সব রোড দিয়ে এক ঘণ্টা আগেও চলাচল ছিল প্রায় বন্ধ।
মুহূর্তের মধ্যে সেখানে লাখো মানুষের উল্লাসে এক নজিরবিহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ যেন এক ঐতিহাসিক দৃশ্য। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উল্লসিত ছাত্র-জনতা সেখানে ঢুকে পড়ে। এ সময় অনেককেই যে যার মতো করে যা পেয়েছেন তাই নিয়ে চলে যেতে দেখা যায়। ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর এই ভবনে উঠেছিলেন বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অসহযোগের দ্বিতীয় দিন ছিল সোমবার। সর্বত্র সান্ধ্য আইন। সবগুলো টেলিভিশনের স্ক্রলে প্রচার হচ্ছিল ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশনা। ‘পাশ ছাড়া কেউ রাজপথে বের হবেন না। তাহলে আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ নেওয়া হবে।’ পুরো দেশে থমথমে অবস্থা। রোববার একদিনে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর পর পাড়ায়, মহল্লায় স্তব্ধতা। বেলা ১২টা পর্যন্ত যেন সব টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিদায়ি সরকারের হাতে। অজানা নিয়ন্ত্রণস্থল থেকে যা বলানো হচ্ছে তাই যেন প্রচার করছে সব গণমাধ্যম। নেটওয়ার্ক বন্ধ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টেলিভিশনের ফ্রিকোয়েন্সিও ডাউন করে দেওয়া হয়। এরপর হঠাৎ করেই পালটে যায় সব পরিস্থিতি। টিভিস্ক্রল পরিবর্তন করে দেখানো হচ্ছিল ‘জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সে পর্যন্ত দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করা হয়।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই কোনোরকম নির্দেশনা ছাড়াই চালু করা হয় হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যম।
টিভিস্ক্রল দেখে অনেকেই বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রীশাসিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার চলমান থাকাবস্থায় সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা মানেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বুঝতে আর বাকি রইল না কী ঘটতে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনেও। সেখান থেকে ফিরে সামরিক হেলিকপ্টারে ওঠার আগপর্যন্ত পুরো এলাকা কর্ডন করে রাখে সেনাবাহিনী।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিদায়ি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরাতন বিমানবন্দন এলাকা দিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে দেশ ত্যাগ করেছেন নিশ্চিত হওয়ার পরই এসএসএফসহ সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গণভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে সরে পড়েন। এরপরই ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা নিরাপত্তা বেষ্টনী টপকে গণভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ যেন বাঁধভাঙা জনস্রোত।
সরেজমিন দেখা গেছে, সরকার পতনের একদফা দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে মিছিল নিয়ে বেলা ৩টার দিকে তারা গণভবনে ঢুকে পড়ে। এরপর থেকেই গণভবন ছাত্র, খুদে শিশুসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দখলে চলে যায়। গণভবনের সবুজ মাঠে তাদের উল্লাসে ফেটে পড়তে দেখা যায়। এ সময় অনেককে কোলবালিশ, ঘটি-বাটি ও বালতি ভরে গণভবনের বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায়। কারও হাতে চেয়ার, কারও হাতে বড় মাছ বা কারও হাতে কবুতরও দেখা গেছে।
এ সময় এক বয়স্ক লোক দুই হাতে দুটি কুরআন শরিফও নিয়ে যায়। মোট কথা, যে যেভাবে যা পেয়েছে নিয়ে গেছেন। ছাত্র-জনতা সেখানে বিজয়োল্লাস করে ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ ও ‘পালাইছে’ ‘পালাইছে’সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। এছাড়া গণভবন থেকে নামিদামি জিনিসপত্র, টেলিভিশন, ফুলের টব, হাঁস, বালতি, মাছ, মাংস নিয়েও বের হতে দেখা গেছে।