ডেমু ক্রয়ে সম্পৃক্তদের তলব
দায়িত্বে অবহেলায় বরখাস্ত হচ্ছেন অতি. মহাপরিচালক
যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রেলে অনিয়ম-দুর্নীতি যেন পদে পদেই। দায়িত্ব পালনে কর্মকর্তাদের ধীরগতি চলছেই। একই সঙ্গে রেলে নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিতে চরম অনীহা দেখা যাচ্ছে। রেলপথমন্ত্রী কিংবা সংসদীয় কমিটির সভাপতি-কারও নির্দেশনাই মানছেন না কোনো কোনো রেল কর্মকর্তা। এতে বিশেষ করে ট্রেন, স্টেশন, রেলপথে নিরাপত্তা জোরদার হচ্ছে না। নাশকতা রোধ ও অপরাধীদের চিহ্নিত করতে ট্রেন ও ট্রেনের ইঞ্জিন-গার্ড বগিতে সিসি ক্যামেরা লাগানোর নির্দেশনা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে ডেমু ক্রয়ে প্রায় ৬৫৩ কোটি টাকা জলে গেলেও এর দায় নিচ্ছে না কেউ। এমন অবস্থায় ডেমু ক্রয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দেশ-বিদেশি সরবরাহকারীদের তলব করেছে সংসদীয় কমিটি। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতায় রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) পার্থ সরকারকে বরখাস্তের সুপারিশ করেছে ওই কমিটি।
এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বিকালে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই চেষ্টা করছি রেল সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। নাশকতা রোধ ও অপরাধীদের চিহ্নিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠপর্যায়েও কাজ চলছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে কিছু কর্মকর্তার মধ্যে ধীরগতিও দেখা যাচ্ছে। নির্দেশনা উপেক্ষা করছে একের পর এক। বুধবার রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিছু কর্মকর্তার অনিয়ম ও দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার বিষয়টিও উঠে আসে বৈঠকে।’
জিল্লুল হাকিম আরও বলেন, ‘কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনিয়মের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতায় রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) পার্থ সরকারকে বরখাস্তের সুপারিশ করা হয়েছে বৈঠকে। সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করে রেলের নিরাপত্তা বিনষ্টকারীদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। কয়েক দিনের মধ্যেই এ সুপারিশ কার্যকর করা হবে। আমরা যাত্রীসেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বোচ্চ কাজ করছি। কিছু কর্মকর্তা নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছেন না। বৃহস্পতিবার থেকে ট্রেন পরিচালনা করছি। কয়েকদিনের মধ্যে আন্তর্দেশীয় এবং সবকটি আন্তঃনগর ট্রেনও চালানো হবে। এমন অবস্থায় রেলওয়ে আইনশৃঙ্খল বাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থানে আছেন।’
এদিকে রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী রেলপথের নির্দিষ্ট কিছু স্থান, ট্রেনের ইঞ্জিন ও ট্রেনের ভেতর সিসি ক্যামেরা স্থাপনের কথা। কিন্তু রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) পার্থ সরকার বিষয়টি যথাযথ আমলে নেননি। বিভিন্ন নাশকতায় রেলপথ উপড়ে ফেলাসহ ট্রেনের ইঞ্জিন, কোচ, স্টেশন ও রেলওয়ে ব্রিজে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কোচের ভেতর অগ্নিসংযোগে অনেক হতাহতের ঘটনাও ঘটে। এসব স্থানে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের নির্দেশ উপেক্ষা করেন পার্থ সরকার। তাছাড়া রেলে চলন্ত ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল, ইঞ্জিল ফেলের ঘটনা নিত্যদিনের হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। একটি চক্রের মাধ্যমে ইঞ্জিন-কোচের যন্ত্রাংশ স্থানীয় ভাবে কিনে দেখানো হচ্ছে উন্নত রাষ্ট্র থেকে এসব ক্রয় করা হচ্ছে।
সংসদীয় কমিটি ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পূর্বাঞ্চল রেলে বছরে ৪টি মিটারে ২০ কোটি টাকার বিল প্রদান করা হয়। পদে পদে বিদ্যুৎ চুরি করা হচ্ছে। রোলিংস্টক ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি ছেয়ে গেছে। ডেমু নিয়ে একাধিক নিউজ হয়েছে। ডেমু ক্রয়ে ৬৫৩ কোটি টাকা জলে গেল। কেউই দায় নিতে চাচ্ছে না, দায়ীদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আসতে হবে। সংসদীয় কমিটিতে ডেমুর সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে-রেলের এডিজি (রোলিংস্টক) পার্থ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি। এদিকে ডেমু ক্রয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা, একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে তলব করেছে সংসদীয় কমিটি। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ডেমু ক্রয়সংক্রান্ত সব ধরনের পেপার সংগ্রহ করা হচ্ছে। ডেমু ক্রয়, সরবরাহের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ফেঁসে যাচ্ছেন। কেউ কেউ দায় এড়াতে দৌড়ঝাঁপও করছেন।
মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘রেলের রোলিংস্টকে দায়িত্বে থাকা পার্থ সরকার ধীরগতির কর্মকর্তা। তাছাড়া সরকারের অতি জরুরি কাজ হলে তিনি নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেন। তার অধীন কর্মকর্তাদের সঙ্গে রেল উন্নয়নে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা করেন না। ডিসেম্বরে রেলের মহাপরিচালক হওয়ার কথা রয়েছে তার। রেলে মহাপরিচালকের পদ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ দীর্ঘদিনের। তিনি ব্যস্ত ওই পদ পেতে।’
বুধবারের সংসদীয় কমিটির বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে কমিটির সভাপতি ও সদস্যরা পার্থ সরকারকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। সদস্যরা মন্ত্রণালয় ও সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন না করা এবং অনিময়-দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করলে পার্থ সরকার মনগড়া উত্তর দিতে থাকেন। বৈঠক সূত্র বলছে, পার্থ সরকার বছরের পর বছর দায়িত্বে অবহেলা ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে আসছেন। রেলে যাত্রী নিরাপত্তা ও সম্পদ রক্ষায় হাতে নেওয়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার ধীরগতি রয়েছে। ডেমুর সমস্যা নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হয়। তাছাড়া ডেমুগুলো কেন অচল অবস্থায় পড়ে থেকে ধ্বংস হচ্ছে, রেলের জ্বালানি তেল কোন প্রতিষ্ঠান থেকে কত টাকার ক্রয় করা হয়, বিস্তারিত জানাতেও বলা হয়েছে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, সংসদীয় কমিটি বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে সুপারিশমালাগুলো মন্ত্রণালয়ে আসবে। লিখিত সুপারিশ অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া ডেমু ক্রয় এবং সরবরাহকারীদের আগামী বৈঠকে উপস্থিত করার জন্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ীভাবে কালো তালিকাভুক্ত করা যায় কিনা, তাও বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে রেলে আমূল পরিবর্তন আসছে। একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর সুফল পেতে, রেলের কোনো কর্মকর্তার দায়িত্ব অবহেলা ও অনিয়ম ভয়াবহ অপরাধের শামিল। সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ডেমুর বর্তমান অবস্থাসহ রোলিংস্টক ক্রয়, ইঞ্জিন-কোচসহ যান্ত্রিক মেরামত, ইঞ্জিন ফেল, অনিয়ম বিষয়ে এডিজি (রোলিংস্টক) পার্থ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হলে-তিনি সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। বৈঠকে সব সদস্যের অনুমতিক্রমেই তাকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করা হয়। তাছাড়া ডেমু ক্রয় বিষয়ে সব ফাইল দুদকে দেওয়া হবে।
এদিকে বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার অন্তত নয়বার পার্থ সরকারের ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল নম্বরে কল করে পাওয়া যায়নি। রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।