Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কষ্টে আছেন রাজধানীর নিম্নআয়ের মানুষ

‘দৈনন্দিন খাবার খরচ জোগানোই অসাধ্য’

দিনমজুরদের কাজ নেই, কারও রোজগার নেমেছে অর্ধেকে * সবার প্রত্যাশা-দ্রুত সবকিছু ঠিক হবে

Icon

মতিন আব্দুল্লাহ ও ইয়াসিন রহমান

প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

‘দৈনন্দিন খাবার খরচ জোগানোই অসাধ্য’

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীতে ১৮ জুলাই থেকে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দেশজুড়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে শত তাজা প্রাণ ঝরে। সহিংসতা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়লে তা দমনে সরকার দেশজুড়ে ‘কারফিউ’ জারি করে। যা এখনো চলমান। এ অবস্থায় গত প্রায় ১২ দিনে নিম্নআয়ের মানুষের রোজগারে ভাটা পড়েছে। কারো রোজগার অর্ধেকে নেমেছে। কারো রোজগার নেই বললেই চলে। এমন বাস্তবতায় বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন রাজধানীর নিম্নআয়ের মানুষ। এমনকি গণপরিবহণ চলাচল সীমিত হয়ে পড়ায় অনেকটা আয়হীন হয়ে পড়েছেন পরিবহণ শ্রমিকরাও।

সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কারফিউ শিথিলের মধ্যে কাজের জন্য নানা সরঞ্জাম নিয়ে বসে আছেন ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ বহু মানুষ। বের হয়েছেন হকার ও ফুটপাতের দোকানিরাও। কিন্তু এখন আগের মতো আয় না থাকায় দৈনন্দিন খাবারের খরচও জোগাড় করতে পারছেন না। বসিলাসংলগ্ন ঘাটারচরের সিএনজিচালক জাহাঙ্গীর আলমের বাসা সাভারের ভাকুর্তার বাহেরচরে। ঘাটারচর থেকে শ্যামলাসী পর্যন্ত রুটে সিএনজি অটোরিকশা চালান তিনি। স্বাভাবিক সময়ে খরচ বাদে দৈনিক ১ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন। ছাত্র আন্দোলন ও কারফিউর কারণে কয়েকদিন বাসা থেকে বের হতে পারেননি। এখন আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় নেমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ৬ জনের সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে। একটি ট্রিপের জন্য আধা ঘণ্টা ধরে বসে রয়েছি। কোনো যাত্রীর দেখা নেই। স্কুল বন্ধ, মানুষের মাঝে আতঙ্ক; জরুরি না হলে মানুষ বাসা থেকে বের হচ্ছে না।’

রামপুরা এলাকায় কথা হয় চা, পান, সিগারেট বিক্রেতা মো. বরকত আলীর সঙ্গে। কেমন আছেন-এমন প্রশ্নে চোখ ছলছল করে ওঠে তার। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটি আক্ষেপ করে বলেন, ‘গত ৮-১০ দিন সীমাহীন কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে। প্রতিদিন পান-সিগারেট বিক্রি করে তার আয় হতো ৩০০-৪০০ টাকা। তবে এ কয়দিন সহিংসতার মধ্যে একেবারে আয় হয়নি।

তাই দুবেলা ভাত মুখে ওঠাতে পারেননি। এমনকি ওষুধও কিনতে পারেননি। সোমবার বিকাল পর্যন্ত তিনি ১৮৬ টাকা বিক্রি করেছেন জানিয়ে বলেন, ‘এই টাকা দিয়ে কি করব? চাল বা ডাল কিনব? নাকি ওষুধ কিনব?’

বরকত আলীর সঙ্গে কথা বলার সময় যোগ দেন আরেকজন চা-পান বিক্রেতা। তিনি বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় মন থেকে এখনও আতঙ্ক দূর হচ্ছে না। কবে সব ঠিক হবে আর কবে দুই বেলা ভাত খেতে পারব জানি না। গলিতে গলিতে যেটুকু সম্ভব ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছি। পুলিশের গাড়ির হুইসেল শুনলেও ভয় লাগে। এজন্য স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

২৫ বছরের যুবক আব্দুল মালেক। ভোলার লালমোহন থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকার কেরানীগঞ্জের নয়াবাজার কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। পড়ালেখা বেশিদূর এগোয়নি। এক সময় তিনি সিএনজি অটোরিকশা চালানো শিখে নেন। থাকেন বসিলার লাউতলা খালপাড় এলাকায়। প্রতিদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সিএনজি চালান। তবে এখন প্রতিদিন বিকাল ৫টার পরে সড়কে মানুষের দেখা মিলছে না- জানান তিনি। এখন ৫০০ টাকাও আয় হচ্ছে না।

আব্দুল মালেক জানান, ১৯ জুলাই বসিলা সড়কে বাসার নিচ তলার অটোরিকশাচালকও সড়কের পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছেন। এরপরও হাতে কোনো টাকা না থাকায় শনিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সড়কে নেমেছিলেন। তবে তার মায়ের অনুরোধের কারণে এরপর কয়েকদিন আর বের হননি। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও তার এখনকার রোজগার দিয়ে মালিকের খরচ শোধ করার পর সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।

কোটা আন্দোলনে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে রাজধানীর বাড্ডা এলাকা। সোমবার উত্তর বাড্ডায় কথা হয় রিকশাচালক মো. আমিনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, যেদিন থেকে শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে দিল, ‘সেদিন থেকেই রিকশা নিয়ে রাস্তায় নামতে পারেননি। একদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছে, অন্যদিকে প্রশাসন গুলি করেছে-কিভাবে আমরা রিকশা নিয়ে নামি। পরিবারে দুই মেয়ে, স্ত্রী ও মা কে নিয়ে থাকেন। এই কয়দিন আয় না থাকায় তাদের মুখে খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। ছোটো মেয়েটা ক্ষুধার জ্বালায় কেঁদে ওঠে। আমি সইতে পারি না। রিকশা নিয়ে বের হতে চাইলে মহাজন জানান-রিকশার ক্ষতি হলে তা ঠিক করে দিতে হবে। এমন শর্ত মেনে নিয়ে ২ দিন বের হয়েছিলাম। প্রথম দিন অলিগলিতে রিকশা চালিয়ে ৩২০ টাকা আয় হয়। মহাজনের জমা ২৫০ টাকা দেওয়ার পর ৭০ টাকা থাকে। পরের দিন ১২০ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরি। এই টাকা দিয়ে কি হয়? এক হালি ডিমের দাম ৬০ টাকা। তরি-তরকারির কেজি ৮০ টাকার নিচে ছিল না। মোটা চালের কেজিও ৫৫ টাকার উপরে ছিল। তাই যে টাকা আয় হয়েছিল তা দিয়ে সামাণ্য পরিমাণ চাল-ডাল কিনে ঘরে ফিরি।’

রায়ের বাজারের সিকদার রিয়েল এস্টেটে ডাব বিক্রি করেন মো. আলমগীর হোসেন। তিন মেয়ে ও ২ ছেলে নিয়ে তার সংসার। প্রতিদিন তিনি ৭০ থেকে ৮০টি ডাব বিক্রি করে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা রোজগার করতেন। ছাত্র আন্দোলন ও কারফিউর পর থেকে কিছুদিন বাসা থেকে বের হননি। মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, গত কয়েকদিন থেকে বের হচ্ছেন। তবে মানুষ বের না হওয়ায় ২০ থেকে ২৫টির বেশি ডাব বিক্রি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সংসার চালাতে তার হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান।

কাওরান বাজারের দিনমজুর রফিউল মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আমার পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে। তাদের ভরণ-পোষণ আমার একার আয় দিয়ে করতে হয়। সপ্তাহে ৩ দিন কাজ পেলে দিনে ৫০০ থেকে কখনো ৭০০ টাকা আয় হয়। সম্প্রতি সহিংসতায় সবকিছু বন্ধ থাকায় ঘর থেকে বের হতে পারিনি। তাই আয় একেবারে হয়নি। আমি আর বউ না খেয়ে থাকতে পারলেও ছেলেমেয়ে ও মা-বাবার দিয়ে তাকাতে পারছিলাম না। তাই বাধ্য হয়ে পাড়ার দোকান থেকে বাকি কিনে খেতে হয়েছে। তিনি জানান, দোকানে ১১০০ টাকা বাকি হওয়ায় আর বাকি দেয়নি। এখন কাজ পেলেও আগের মতো আয় হচ্ছে না। আজ ৩৫০ টাকা আয় হয়েছে। নিত্যপণ্যের যে দাম, এই অল্প টাকা দিয়ে কি কিনব, আর দোকানের বাকি কিভাবে পরিশোধ করব বুঝতে পারছি না।

হাজারীবাগের কোম্পানিঘাট বাজারের মুদি দোকানদার মো. লিটন জানান, ছাত্র আন্দোলন ও কারফিউর মধ্যে তিনি দোকান খুলেছেন। ওই এলাকায় কোনো গণ্ডগোল না হলেও ক্রেতা না থাকায় বিক্রি মন্দা। গত প্রায় ১২ দিন রোজগার নেই বললেই চলে।

রাজধানীর শাহাজাদপুরে রাস্তার পাশে চটপটি-ফুচকা বিক্রেতা হায়দার জানান, পরিবারের পাঁচ সদস্যের সংসারের যাবতীয় খরচ তার উপার্জনেই চলে । কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত দুই সপ্তাহের সংঘাতপূর্ণ সময়ে তিনি চটপটি নিয়ে বের হতে পারেননি। উপার্জনহীন এই দিনগুলোতে স্থানীয় মুদি দোকান থেকে বাকিতে চাল, আলু আর ডাল কিনে কোনো রকমে সপ্তাহ পার করেছেন। কারফিউ শিথিল হওয়ার পর চটপটি নিয়ে ফুটপাতে বের হয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে আবার কারফিউ থাকায় বিক্রি করতে পারছেন না। তিনি বলেন, সন্ধ্যায় ক্রেতা বেশি থাকত। আর এমন সময় ক্রেতারাও এখন আসে না। এমন পরিস্থিতিতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

রাজধানীর খেটে খাওয়া দিনমজুর শ্রেণির এসব মানুষ তাকিয়ে আছে কবে দেশ স্বাভাবিক হবে। তাদের প্রত্যাশা-দ্রুত সবকিছু ঠিক হবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম