১২ দিনে লোকসান অর্ধশত কোটি টাকা
নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় ট্রেন চলা অনিশ্চিত
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
ট্রেন চলাচল বন্ধ ১৭ জুলাই থেকে। কিন্তু কবে নাগাদ ট্রেন চলবে, এমনটাও নিশ্চিত বলতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। গত ২ দিন আগে কম দূরত্বের মধ্যে ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, কম দূরত্বে চলাচল করা মেইল, লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চালানো হলে ঝুঁকি আরও বাড়বে। দুর্বৃত্তদের হামলায় ট্রেন, স্টেশন, লাইন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগসহ যাত্রী হতাহতের শঙ্কাও রয়েছে।
এদিকে সারা দেশে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় প্রতিদিন রেলের ৪ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনতে হচ্ছে। অপরদিকে যাত্রীদের অভিযোগ, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসায় সড়কে যান চলাচল করলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। ট্রেন কবে চালাবে তাও বলা হচ্ছে না। এতে ট্রেনে যাতায়াতকারী হাজার হাজার যাত্রী সাধারণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা মনে করেন, এটি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের চরম ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছু নয়।
এ প্রসঙ্গে রেলপথমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যাত্রীদের নিরাপত্তা সবার আগে। ট্রেন নীরব, খাল-বিল, পাহাড়ঘেঁষা এলাকাজুড়ে চলে। বর্তমানে কারফিউ চলছে, একই সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থাও ফিরে আসেনি। এমন অবস্থায় ট্রেন চালানো খুবই ঝুঁকির-শঙ্কার। যাত্রী নিরাপত্তা ও রেল সম্পদ রক্ষায় দেশে পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলেই ট্রেন চালানো সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, এমনিতে রেলে ইঞ্জিন ও কোচ স্বল্পতা রয়েছে। এখন যদি ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালানো হয় সেক্ষেত্রে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটলে এ সমস্যা আরও বাড়বে।
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘রেলওয়ে আইনশৃঙ্খল বাহিনী সতর্কাবস্থাতে আছে। কিন্তু ট্রেন চলে বিভিন্ন জেলাজুড়ে। জেলাভিত্তিকও নিরাপত্তা নিশ্চিত জরুরি। ডিসি, এসপিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যাত্রী ও রেলসম্পদ নিরাপত্তার বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত না হলে ট্রেন চালাতে পারছি না। রেল উন্নয়নে আমূল পরিবর্ত আসছে। রেলবহরে অত্যাধুনিক ট্রেন যুক্ত হচ্ছে, আধুনিক লাইন তৈরি হচ্ছে। এসব স্থাপনায় নাশকতার নীলনকশা তৈরি করছে জামায়াত, শিবির ও বিএনপির সন্ত্রাসীরা। ইতোমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে ইঞ্জিন, কোচ, স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে দেশবিরোধীরা।’
এদিকে শনিবার কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, পুরো স্টেশন চত্বর জনশূন্য অবস্থা। তবে নিরাপত্তায় স্টেশনে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থাতে রয়েছে। দোকানপাট বন্ধ, নির্ধারিত স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ট্রেন। স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রায় ১১ দিন ধরে ট্রেন চলাচল বন্ধ। কবে নাগাদ ট্রেন চলবে তাও বলা সম্ভব হচ্ছে না। গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চলা মৈত্রী ও মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের অগ্রিম কাটা টিকিট ফেরত নিয়ে সমপরিমাণ টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। বাকি ট্রেনের টিকিট ফেরত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কাউন্টার এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাটা টিকিটের মূল্য এখনও পরিশোধ করা হচ্ছে না। ইন্টারনেট পুরোপুরি সচল না হলে মূল্য ফেরত সম্ভব হবে না।’
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিংস্টক) পার্থ সরকার বলেন, ইঞ্জিন-কোচের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন সময় নাশকতাকারীরা ইঞ্জিন-কোচ জ্বালিয়েও দিয়েছে। এখন যে অবস্থায় চলছে, ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে গেলে ইঞ্জিন-কোচসহ রেল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
এমনিতেই রোলিংস্টক স্বল্পতায় ট্রেন চালাতে হিমশিম খেতে হয়। সরকার প্রয়োজনীয় ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ করছে। সংগৃহীত ইঞ্জিন-কোচ ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ হলে চরম ক্ষতি হয়ে যাবে।
রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আরিফুজ্জামান আরিফ যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশের অধিকাংশ স্টেশন ডিজিটাল সিস্টেমে পরিচালিত হয়। টিকিট বিক্রি থেকে শুরু করে ট্রেন পরিচালনায় প্রায় ৯৫ শতাংশ কার্যক্রমই ইন্টারনেট-ডিজিটাল সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল। ইন্টারনেটসহ পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে ট্রেন চালানো নিয়ে ভাবা যাবে। এছাড়া ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালানো মানে, যাত্রীসহ রেলের সম্পদ ক্ষয়ক্ষতি হওয়া।’
ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা শাহ আলম কিরণ শিশির যুগান্তরকে জানান, ট্রেন বন্ধ থাকায় লোকসানের পাল্লা ভারী হচ্ছে। আবার টিকিট ফেরত রেখে সমপরিমাণ টাকা যাত্রীদের দিতে হবে। রেলওয়ে অপারেশন দপ্তর সূত্র বলছে, রেল প্রতিদিন ৪ কোটি ১২ লাখ টাকা আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ হিসাবে ১২ দিনে লোকসান হয়েছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। পূর্বাঞ্চল রেলে ট্রেন পরিচালনায় বছরে প্রায় ৮শ কোটি টাকা আয় হয়। দুই অঞ্চলে প্রায় ১৫শ কোটি টাকার উপরে আয় হয়।
মৈত্রী ও মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনের অগ্রিম টিকিট কাটা যাত্রীরা কমলাপুর স্টেশন থেকে টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া দুদেশের মধ্যে ট্রেন চলাচলও বন্ধ রয়েছে। আন্তঃদেশীয় ট্রেনগুলো কবে চলবে, তা নিশ্চিত বলছে না রেল কর্তৃপক্ষ। রেলওয়ে পরিবহণ দপ্তর সূত্র বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতায় রেলেও ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। ১৩টি স্টেশন ভাঙচুর করা হয়েছে। এসব স্টেশন এখনও মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ইঞ্জিন ও ৯টি কোচে অগ্নিসংযোগ-ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি পুরোপরি স্বাভাবিক না হলে ট্রেনচালক, গার্ডসহ সংশ্লিষ্টরাও ট্রেন পরিচালনায় সাহস পাচ্ছেন না।
কমলাপুর রেলওয়ে প্রশাসনিক দপ্তর সূত্রে জানা যায়-চালক, গার্ডরাও এমন পরিস্থিতিতে ট্রেন চালাতে চাচ্ছেন না। গত ২ দিন আগে কম দূরত্বের মধ্যে লোকাল-মেইল ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত হলে ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তরা ঝুঁকির বিষয়টি সামনে আনেন। একজন ট্রেনচালক বলেন, গুটিকয়েক সহিংসতাকারী একত্রিত হলেই ট্রেন দাঁড় করাতে হয়। লাইন, সিগন্যাল পয়েন্টে হামলা চালায় দুষ্কৃতকারীরা। মুহূর্তেই লাইন ঘেরাও করে ট্রেন ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা শুরু করে। ওই অবস্থায় ট্রেন যাত্রীদের সঙ্গে ট্রেন পরিচালনায় সম্পৃক্তদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে।
রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা কিছুতেই ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালাতে চাচ্ছি না। যাত্রী নিরাপত্তার দিকটি সবার আগে দেখতে হচ্ছে। এছাড়া ইঞ্জিন-কোচসহ রেলসম্পদ রক্ষায় পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না এলে-ট্রেন চালানো চরম ঝুঁকির হবে।’