কোটা সংস্কার আন্দোলন
পচন ধরায় আট মৃতদেহ আঞ্জুমানে মফিদুলে হস্তান্তর
ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও তিনজনের মৃত্যু
ইকবাল হাসান ফরিদ
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
প্রতীকী ছবি
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় হতাহতদের পাশাপাশি এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। এই নিখোঁজদের সন্ধানে তাদের স্বজনরা প্রতিদিনই হাসপাতাল, মর্গ, থানা, এমনকি আদালতের বারান্দায় ভিড় করছেন। নিখোঁজ স্বজনরা বেঁচে আছেন কি না, তা নিশ্চিত হতে চান তারা। এদিকে পচন ধরায় পরিচয়বিহীন আট মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে বুধবার দুপুরে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জানা যায়, পরিচয়বিহীন এই আট মৃতদেহের মধ্যে একজনের বয়স আনুমানিক ২২ বছর, একজনের ২৫, একজনের ২৮, দুইজনের ৩০, একজনের ৩৫, একজনের ৪০ এবং একজনের ৫০ বছর। এ মৃতদেহগুলোর ছবি তুলে মর্গে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। তাছাড়া ময়নাতদন্ত করার সময় ডিএনএ স্যাম্পল সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে মর্গ সূত্র দাবি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মৃতদেহগুলো পচেগলে বিকৃত হয়ে গেছে। তাছাড়া তাদের কোনো স্বজন না পাওয়ায় দাফনের জন্য আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢামেক মর্র্গ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গ, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মর্গ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই এসব হাসপাতাল এবং মর্গ এলাকায় স্বজনদের খোঁজে লোকজন আসছেন। তারা স্বজনদের ছবি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সন্ধান চাইছেন। শাহবাগ থানার একটি সূত্র যুগান্তরকে জানায়, থানার গেটেও লোকজন আসছেন স্বজনদের খোঁজে। এভাবে বিভিন্ন হাসপাতাল ও থানার গেটে লোকজন ভিড় করছেন স্বজনদের খোঁজে।
মঙ্গলবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে আসেন শনির আখড়ার গরীবের বাজার এলাকার লাবনী বেগম। তিনি জানান, তার স্বামী রাসেল মিয়া (২৪) পল্টন এলাকায় একটি ওষুধের দোকানে কর্মচারী। গত শনিবার দুপুরে বাসা থেকে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন তিনি। এরপর থেকে তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। রাসেল মিয়া বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন, কিছুই জানেন না লাবনী বেগম। মর্গের কর্মী বাবুল মিয়া তাকে অজ্ঞাতদের ছবি দেখান। সেখানে স্বামীকে শনাক্ত করতে না পেরে ফিরে যান লাবনী। তিনি জানান, কদিন ধরে হাসপাতাল, মর্গ, থানা কোথাও স্বামী রাসেলের হদিস পাচ্ছেন না তিনি।
যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ এলাকায় জালালীয়া কনফেকশনারিতে কাজ করত শিপন মিয়া (১৪)। শুক্রবার সে নিখোঁজ হয়। এরপর থেকে হাসপাতালে হাসপাতালে সন্ধান করছেন শিপনের স্বজনরা। বুধবার শিপনের নিকটাত্মীয় শাহাদাত হোসেন ঢামেক মর্গে আসেন। তিনি জানান, শুক্রবার সংঘর্ষের সময় শিপন দোকান বন্ধ করে নারিন্দা রোডের বাসায় যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়। এরপর থেকে তার কোনো হদিস মিলছে না।
শুধু রাসেল আর শিপনের স্বজনরাই নন, প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন স্বজন নিখোঁজদের সন্ধানে ঢামেক মর্গে আসছেন বলে যুগান্তরকে জানিয়েছেন মর্গের কর্মী বাবুল মিয়া। এদিকে ঢামেক জরুরি বিভাগ সূত্র জানায়, নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান পেতে প্রতিদিনই লোকজন এই হাসপাতালে আসছেন। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে স্বজনদের খুঁজছেন।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গের সহকারী যতন ডোম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, মর্গে প্রতিদিনই নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ করতে ১০-১৫ জন নারী পুরুষ মর্গে আসছেন।
শিশুসহ চিকিৎসাধীন তিনজনের মৃত্যু : ঢামেক হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সহিংসতায় আহতদের মধ্যে বুধবার এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন নারায়ণগঞ্জের সাড়ে ছয় বছর বয়সি রিয়া গোপ, মহাখালীর সাততলা বস্তির বাসিন্দা শাহজাহান ওরফে হৃদয় (২২) ও কোনাপাড়ার একটি মাদ্রাসার ছাত্র সাজেদুর রহমান (২২)। তাদের মধ্যে দুজনের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত বুধবার ঢামেক মর্গে সম্পন্ন হয়েছে। এ নিয়ে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় নিহতদের মধ্যে ৮৬ জনের মৃতদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে ঢামেক মর্গে। এছাড়া সহিংসতায় আহত হয়ে ১৭ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ১ হাজার ২৫৪ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে তিন শতাধিক রোগীকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়, যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, সহিংসতায় নিহত অনেক মরদেহ পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই হাসপাতাল থেকে হস্তান্তর করেছে থানা পুলিশ। তবে সহিংসতায় মোট কতজন মারা গেছেন, এ সংখ্যা হাসপাতালের ক্যাম্প পুলিশের কাছে নেই।
শিশু রিয়া গোপের বাবার নাম দীপক কুমার গোপ। বাসা নারায়ণগঞ্জ সদরের নয়ামাটি এলাকায়। শুক্রবার বাসার পঞ্চম তলার ছাদে উঠে খেলা করছিল শিশু রিয়া। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলাকালে হঠাৎ একটি গুলি এসে রিয়ার মাথায় বিদ্ধ হয়। এরপর তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বুধবার সকাল ১০টায় মারা যায় রিয়া।
নিহত শাহজাহান ওরফে হৃদয় মহাখালী সাততলা বস্তির বাসিন্দা। সে মহাখালী এসকে টাওয়ারে একটি প্যাকেজিং কোম্পানিতে কাজ করত। তার বোন কুলসুম আক্তার জানান, শুক্রবার বিকেলে মহাখালী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত ১টায় সে মারা যায়। ঘটনাস্থল নিয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও বনানী থানার ঠেলাঠেলির কারণে বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টা পর্যন্ত হৃদয়ের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়নি। তবে পরে ঘটনাস্থল বনানী থানা এলাকায় বলে সিদ্ধান্ত হওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্নের কাজ চলছে। এছাড়া ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া সাজেদুর রহমানের বাড়ি বিবাড়িয়া সদরে। সে ডেমরার কোনাপাড়া এলাকার একটি মাদ্রাসায় পড়ত। বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় সে মারা যায়। তবে তার স্বজনরা গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।