সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার উন্নতি, রংপুর-কুড়িগ্রামে দিশেহারা কৃষক
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার উন্নতি, রংপুর-কুড়িগ্রামে দিশেহারা কৃষক](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/06/23/image-819270-1719097011.jpg)
বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া হাসপাতাল প্লাবিত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে হাজার হাজার রোগী। বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন আতঙ্ক।
কুড়িগ্রাম ও রংপুরে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতিতে দিশেহারা কৃষকরা। দরিদ্ররা খাদ্যাভাবে মানবেতর দিন যাপন করছেন। ত্রাণ কার্যক্রম চললেও তা অপ্রতুল বলে অভিযোগ বানভাসিদের। ত্রাণের জন্য আকুল আকুতি জানাচ্ছেন তারা। যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :
সিলেট: সিলেটে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। খুব ধীরগতিতে বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এখনো সুরমা নদীর পাঁচটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে।
কিছু এলাকায় পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক পরিবার বাড়িতে চলে আসছে। তবে সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকার ড্রেন, ছড়া, খাল পরিষ্কার না থাকা এবং এক ড্রেনের সঙ্গে অন্য ড্রেনের সংযোগ না থাকায় পানি নামছে না।
নদীনালা, খালবিল পানিতে টইটম্বুর থাকায় ড্রেনের ময়লা উপরে উঠে এসে সৃষ্টি হয়েছে দুর্গন্ধময় পরিবেশ। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে জমে আছে ময়লা পানি। সিলেট জেলার ৯ লাখেরও বেশি মানুষ এখনো পানিবন্দি। প্রায় ৪০০ আশ্রয়কেন্দ্রে ২৫ হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।
কুশিয়ারা ছাড়া সিলেটের বাকি সব নদ-নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। শুধু কুশিয়ারা নদীর ৩টি পয়েন্টে পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় জানায়, শনিবার বিকালের দিকে সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে এ নদীর পানি সিলেট পয়েন্টে রয়েছে বিপৎসীমার নিচে।
একই সময়ে কুশিয়ারা নদীর পানি আমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০২ ও শেরপুর পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে নগরীর দক্ষিণ সুরমার বঙ্গবীর রোডের দোকানপাট গত ৭ দিন ধরে বন্ধ। বঙ্গবীর রোডে হাঁটুসমান পানি।
তালতলা, জামতলা, ভার্থখলা, ঝালোপাড়া, তেরোরতন, যতরপুর, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, উপশহর ও সোবহানিঘাট এলাকার বাসাবাড়িতে হাঁটুপানি।
এদিকে, সিলেটসহ দেশের ১১টি অঞ্চলে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি অথবা বজ সহ বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে এমন আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এসব এলাকায় ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৬০ কিলোমিটার বেগে অস্থায়ীভাবে দমকা-ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ সহ বৃষ্টি হতে পারে। শনিবারের আবহাওয়া বার্তা এমনটি জানিয়েছে।
সুনামগঞ্জ: সুনামগঞ্জে ধীরে ধীরে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গত তিন দিন ধরে বৃষ্টিপাত কমে রোদেলা আবহাওয়া বিরাজ করায় জেলাবাসীর জীবনে স্বস্তি ফিরেছে। তবে জেলা শহরের বেশিরভাগ জনবসতি ও সড়কে এখনো হাঁটুপানি।
কোনো কোনো আবাসিক এলাকায় এখনও বাসিন্দাদের চলাচল করতে হচ্ছে নৌকায় করে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে রোদের দেখা পায় সুনামগঞ্জবাসী। উন্নতি ঘটতে থাকে বন্যা পরিস্থিতির। শনিবার বিকালে সুরমা নদীর পানি শহরের ষোলঘর পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
এছাড়া জেলার সকল নদ-নদীতে পানি কমছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবারকার বন্যা স্বল্পমেয়াদি হলেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর। গ্রামীণ সড়ক, যেগুলো কম টাকা খরচ করে করা হয়, সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। নিম্ন আয়ের গরিব মানুষ যারা কাঁচা ঘরবাড়িতে থাকেন, তাদের ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যায় এলজিইডির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার সড়ক এখনো পানির নিচে রয়েছে। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১৭শ হেক্টর আউশ ধান ও ৫৬৭ হেক্টর সবজি। ৩ হাজার ৬১১টি পুকুর বা খামার বন্যার পানিতে ভেসে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ৩৯ লাখ টাকার পশুখাদ্যের ক্ষতি হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, ‘প্রত্যেক বছর এভাবে বন্যা আক্রান্ত কেন হয় সংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভা, সেমিনার করে এটা বের করতে হবে। স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। এখানকার মানুষকে নিরাপদ করার জন্য যা যা করণীয় সবকিছু করার জন্য আমরা উদ্যোগ নেব।’
ছাতক (সুনামগঞ্জ): ছাতকে সার্বিক বন্যা পরিস্থিরি উন্নতি হলেও বিভিন্ন এলাকায় এখনো সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। শহরের বন্যার পানি কমলেও বেশিভাগ গ্রামে আরও অবনতি ঘটেছে। আবার কোথাও কোথাও রয়েছে স্থিতিশীল।
নিম্নআয়ের মানুষ, দিনমজুররা আশ্রয় নিচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রে, বড় নৌকায় আর যাদের অবস্থা কিছুটা ভালো তারা উঠেছেন আবাসিক হোটেলে। কেউ কেউ আছেন প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের বাসায়। দরিদ্ররা খাদ্যাভাবে মানবেতর দিন যাপন করছেন। ত্রাণের জন্য জানাচ্ছেন আকুল আকুতি।
বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের তরফ থেকে সামান্য ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা কেউ পাচ্ছেন আবার কেউ পাচ্ছেন না বলে বানভাসিদের দাবি। প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলছে ত্রাণ বিতরণ।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) : জগন্নাথপুরে বন্যা পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। খুবই ধীরগতিতে কমছে পানি। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
নেত্রকোনা : জেলার কলমাকান্দা উপজেলায় উব্দাখালী নদীর পানি কমতে শুরু করছে। তবে এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার বারহাট্টা, পূর্বধলা এবং খালিয়াজুরিতে পানি কিছুটা বেড়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা। পানি কমলেও বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি।
স্থানীয় সংসদ-সদস্য মোশতাক আহমেদ রুহী, জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ এবং ইউএনও আসাদুজ্জামান বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে নদীতে পানি কমলেও ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষ। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বন্যার্তদের সংখ্যা বেড়েছে। তবে বৃষ্টি না হলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও চাল বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তি, রাজনীতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত আছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার লোকজন। জেলায় মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুও খাদ্য সংকটে পড়েছে।
বড়লেখা (মৌলভীবাজার): হাকালুকি হাওড়পাড়ে অবস্থিত বড়লেখা উপজেলায় গত দুই দিন ভারি বৃষ্টিপাত না হলেও কমছে না বন্যার পানি। নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও হাওড়ের পানি বৃদ্ধিতে নতুন করে উজান এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তবে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। এদিকে ৩৩ আশ্রয়কেন্দ্রে বানভাসি মানুষের সংখ্যা বেড়েছে।
উপজেলা প্রশাসন ১০টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যা দুর্গত এলাকায় ১১ জন সরকারি কর্মকর্তাকে ট্যাগ অফিসার নিযুক্ত করে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন বন্যা কবলিত এলাকার লোকজন।
কুড়িগ্রাম : চলতি বন্যায় কুড়িগ্রামে ১৩শ ২০ হেক্টর জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। এসব ফসলের মধ্যে রয়েছে পাট, আউশ ধান, কাউন, আমনের বীজতলা, বাদামসহ বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি। পানি দ্রুত নেমে না গেলে এসব ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে শুক্রবার থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দ্রুত কমছে নদনদীর পানি। এতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে পানি কমলেও নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের পানি এখনো নামেনি। ফলে এসব এলাকার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ১৪৪ মেট্রিকটন জিআর চাল ও নগদ ১০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ত্রাণ হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলো বন্যা কবলিতদের মাঝে বিতরণ শুরু হয়েছে।
রৌমারী (কুড়িগ্রাম) : রৌমারীতে পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যার পানি কমলেও নানা ধরনের পানিবাহিত রোগবালাই দেখা দিয়েছে। এখনো বেশকিছু এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে আছে।
বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমা ছুঁইছুঁই করছে। শনিবার সকাল পর্যন্ত পানি বিপৎসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তীরে বসবাসকারীদের মাঝে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাধ্য হয়ে কৃষকরা জমিতে থাকা অপরিপক্ব পাট কাটতে শুরু করেছেন।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আগামী দুদিন পানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, উপজেলার যেখানেই নদী ভাঙনের খবর পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই কাজ করা হচ্ছে। তাই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
রংপুর : রংপুর মহানগরীসহ বিভাগের আট জেলায় গত কয়েকদিনের অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। নিচু ফসলি মাঠ ডুবে গেছে। ধানসহ ফসলি জমি পানির নিচে রয়েছে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। উপায় না পেয়ে অপরিপক্ব ধানই কেটে নিচ্ছেন তারা। দ্রুত সময়ের মধ্যে পানি কমে না গেলে কৃষকেরা ক্ষতিতে পড়তে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নদীতে ভাঙন দেখা দেওয়ায় অনেকেই গৃহহারা হয়েছেন।