
প্রিন্ট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩০ এএম
এমপি আনার হত্যাকাণ্ড
নেতাদের নাম আসায় পালটে যাচ্ছে দৃশ্যপট
হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশের পর নানামুখী চাপে পুলিশ * গ্রেফতারের পরও জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহালতবিয়তে দুই নেতা

ইমন রহমান
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ-সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা সামনে আসার পরই পালটে গেছে দৃশ্যপট।
হত্যার পেছনে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের বাঘাবাঘা নেতাদের নাম বেরিয়ে আসা শুরু করলে নানামুখী তদবিরের চাপ বাড়ে। ফলে তদন্তে সতর্ক অবস্থান নেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
আনার হত্যায় সরাসরি জড়িত তিন আসামির আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতার নাম চলে আসে। এর পরই গ্রেফতার হয় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু। নজরদারিতে আছেন আরও কয়েক নেতা।
গ্রেফতার বাবু সাত দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তবে মিন্টুকে আট দিনের রিমান্ডে নিলেও তিন দিনের মাথায় কারাগারে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও মিন্টু অস্বীকার করেছেন।
এছাড়া তিনি আদালতে কোনো জবানবন্দিও দেননি। রিমান্ডের সময় পূর্ণ না করার পেছনে কোনো প্রভাব কাজ করেছে কিনা বা এমপি খুনের সঙ্গে জড়িতরা পার পেয়ে যাচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মিন্টুকে গ্রেফতারের পর আনার হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ১৩ জুন বিকালে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। ওই দিন সন্ধ্যায় ডিবির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ না করার অনুরোধও জানানো হয়।
এদিকে মিন্টু গ্রেফতার হতে পারেন এমনটা বোঝার পরই ঝিনাইদহ থেকে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অনেক নেতার কাছে ধরনা দিয়েছেন বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে।
মিন্টুর পক্ষে অবস্থানও নেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী একাধিক নেতা। ফলে গ্রেফতারের পর মিন্টুর রিমান্ড পূর্ণ না করার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন এমপি আনারের ঘনিষ্ঠরা।
তবে তদন্তসংশ্লিষ্টদের দাবি, মিন্টুর কাছে যে বিষয় জানার ছিল তা জানতে পারায় তাকে আর রিমান্ডে রাখার প্রয়োজন হয়নি। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে ফের তাকে রিমান্ডে আনা হবে।
ডিবির এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মিন্টু ও বাবুকে গ্রেফতারের পর তাদের ঘনিষ্ঠ অনেক প্রভাবশালী নেতা তদবির শুরু করেন।
তারা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন, গ্রেফতাররা দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতা। তবে শুরু থেকেই আনার হত্যার তদন্তে এক পাও পিছু হটেনি ডিবি, সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে-এমন দাবি ডিবির ওই কর্মকর্তার।
এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন প্রথম থেকেই অভিযোগ করে আসছেন মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। প্রভাব খাটিয়ে মূল খুনিদের আড়াল করারও চেষ্টা চলছে। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছেও বিষয়টি তুলে ধরেন। অভিযোগ করেন তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির এক অতিরিক্ত উপকমিশনারের (এডিসি) বিরুদ্ধেও।
বদলির আদেশের পরও ওই এডিসি ডিবিতে থেকে আসামিদের পক্ষে প্রভাব খাটাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল ডরিনের। এর পরই ওই এডিসি বদলিকৃত কর্মস্থলে যোগদান করেন।
এদিকে আনার হত্যায় গ্রেফতারের পরও জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহালতবিয়তে আছেন মিন্টু ও বাবু। গ্রেফতারের বারো দিন অতিবাহিত হয়েছে মিন্টুর, আর ষোল দিন বাবুর।
প্রভাবশালী এই দুই নেতার পদই শুধু বহাল নয়, তাদের পক্ষে আন্দোলন কর্মসূচিতেও নেমেছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। মিন্টুর অনুসারীরা তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন, মিছিলসহ লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ আনার জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য হলেও তার মৃত্যুতে শোকও প্রকাশ করা হয়নি কমিটির পক্ষ থেকে।
আনার হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ এই দুই আসামি ক্ষমতাসীন দলের জেলা কমিটির পদে বহাল থাকায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র বলছে, সাইদুল করিম মিন্টু ২০১৪ সাল থেকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। এর আগে ছিলেন শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও নেতা ছিলেন তিনি। জেলা ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটিও তার নিজের মতো করে সাজানো। মিন্টুর পক্ষের নেতারাই লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আনারের ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা। কালীগঞ্জ থানা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল যুগান্তরকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমপি আনারের জন্য একটি শোকসভা অন্তত করা দরকার ছিল।’
তিনি আরও বলেন, আমি অনেক ছোট পর্যায়ের নেতা, এখন যা হচ্ছে তাতে কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই।’
জানতে চাইলে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ-সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম অপু যুগান্তরকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়ন্ত্রিত হয় কেন্দ্র থেকে। গ্রেফতার দুই নেতার বিষয়ে আমরা কেন্দ্র থেকে কোনো নির্দেশনা পাইনি।’
মিন্টুর পক্ষে আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। মিন্টুর ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা আন্দোলন করছে।’
এমপি আনার হত্যায় শোক প্রকাশ না করার বিষয়ে শফিকুল ইসলাম অপু বলেন, ‘যেহেতু ডিএনএ নমুনা এখনো মেলানো হয়নি, সেহেতু এমপি আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে শোক প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। তার মৃত্যুর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হলে আমরা শোকপ্রস্তাবসহ কর্মসূচি পালন করব।’
উল্লেখ্য, এমপি আনার ১২ মে ভারতে যান। পরদিন ১৩ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন তিনি। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ২২ মে। ওইদিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় আনারের মেয়ে ডরিন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করেন। এছাড়া ভারতে একটি হত্যা মামলা হয়। দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে সাত জনকে গ্রেফতার করেছে।
কালীগঞ্জে আনার হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন : এমপি আনার হত্যার প্রতিবাদে কালীগঞ্জ শহরের কালীবাড়ী মোড়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার সকালে কালীগঞ্জ হাট চাঁদনী কাঁচা ও পাকামাল ব্যবসায়ী সমিতির আয়োজনে এক মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুজ্জামান রাসেল, ইউপি চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু, পৌর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল ইসলাম ইনতাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।