পুলিশ কর্মকর্তার গুণধর ছেলে ‘সিরিয়াল ধর্ষক’
ভুক্তভোগী তরুণীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত, এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৪টি
নেসারুল হক খোকন
প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাহমাতুর রাফসান অর্ণব। ভয়ংকর এক চরিত্রের নাম। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। যার পিতা পুলিশ ইন্সপেক্টর। নাম জাহিদুল ইসলাম। বর্তমান কর্মস্থল পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটে। অথচ নিজেকে ডিআইজির ছেলে পরিচয় দিয়ে ভয়ংকর প্রতারণায় নেমেছেন পুলিশ কর্মকর্তার গুণধর পুত্র অর্ণব। যার প্রেমের ফাঁদে পড়ে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েও সর্বস্বান্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে এ তালিকায় উঠে আসা ভুক্তভোগীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। দামি ব্র্যান্ডের গাড়িতে ডিএমপির লোগো ব্যবহার করে চলাচল করেন হিরো বনে যাওয়া এই ভিলেন। যার টার্গেটের শিকার ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ছাড়াও উদ্দেশ্য নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া।
এদিকে ভুক্তভোগী তরুণীদের কয়েকজন অর্ণবের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেছেন দিনাজপুরে। মাথার ওপর ঝুলছে গ্রেফতারি পরোয়ানাও। কিন্তু কিসের মামলা আর গ্রেফতারি পরোয়ানা। পুলিশপুত্র বলে কথা। কোনো কিছু কেয়ার করেন না তিনি। তাই প্রকাশ্যে ঘুরছেন বুক ফুলিয়ে। গত এক মাস যাবত ভুক্তভোগীদের কয়েকজনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে যুগান্তর টিম। এরপর বেরিয়ে আসে ভয়াবহ সব চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রতিবেদক পাঁচজনের ভিডিও সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়েছেন। নাম পরিচয় গোপন করার শর্তে কথা বলেছেন আরও কয়েকজন। যারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নরত। কেন এরকম বেপরোয়া চরিত্রের যুবকের ফাঁদে তারা পা দিয়েছেন জানতে চাইলে প্রত্যেকে জানিয়েছেন, অর্ণব যে কোনো মানুষকে পাঁচ মিনিটেই বশে আনতে পারে। মেয়েদের কনভিন্স করার বিশেষ সক্ষমতা রপ্ত করেছে সে। এছাড়া প্রতিটি মেয়ে একজন স্বাবলম্বী ও সম্পদশালী স্মার্ট হ্যান্ডসাম ছেলের স্বপ্ন লালন করেন। অর্ণব যার সব কিছুই টার্গেটকৃত মেয়েদের কাছে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারে। এগুলো শো করেই সে বহু তরুণীকে দ্রুত কব্জায় নিতে পেরেছে। কিন্তু যখন তার আসল চেহারা সামনে বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে তারা সব হারিয়ে ফেলেছেন। তারা বলেন, স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করতে না চাইলে সে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। আবার কাউকে নেশা জাতীয় জুস, শরবত কিংবা কফি খাইয়ে ধর্ষণ করে। কিন্তু সে শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, সব কিছু ভিডিও করে রাখে। পরে এই ভিডিও দেখিয়ে ফের ধর্ষণ এবং বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করে বসে। কোনো মেয়ে যখন তার নগ্ন শরীরের ভিডিও ও স্টিল ছবি দেখে তখন তার মাথা আর কাজ করে না। পাগলপ্রায় হয়ে যায়। এজন্য ভুক্তভোগী মেয়েদের অনেকে মানসিক ট্রমায় ভুগছে।
জানতে চাইলে দিনাজপুরের এসপি শাহ ইফতেখার আহমেদ রোববার যুগান্তরকে বলেন, অর্ণবের বিষয়ে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা সত্য। এখানে ভিকটিম যারা থানায় আইনি সহযোগিতার জন্য এসেছিলেন তাদের প্রতি শতভাগ পেশাদারিত্ব বজায় রাখা হয়েছে। একজন পুলিশ সদস্যের ছেলে হলেও তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হয়নি।
কেস স্টাডি : অভিযুক্ত অর্ণব প্রায় অর্ধশত তরুণীকে একই ফর্মুলায় ধর্ষণ ও তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে প্রতিবেদক পাঁচজনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তারা অর্ণবের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দেন। যারা প্রত্যেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তবে তাদের জবানীতে রগরগে যেসব বর্ণনা বেরিয়ে এসেছে তার অনেক কিছুই প্রকাশযোগ্য নয়।
এদের মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফা- আদ্যাক্ষরের জনৈক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, তিনি ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে দিনাজপুরের লিগ্যাসি রেস্টুরেন্টে খেতে যান। এ সময় রেস্টুরেন্ট বেয়ারাদের মাধ্যমে অর্ণব তার বিষয়ে কিছু জানতে চায়। আবার তিনিও সরল বিশ্বাসে তাদের সঙ্গে ফ্রিলি কথা বলার এক পর্যায়ে রেস্টুরেন্ট মালিক হিসাবে সামনে আসেন অর্ণব। এ সময় খাবারের মান নিয়ে বিভিন্ন কথা বলার ছলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কিছু বিষয় জানতে চান তিনি। তার কথার সে আমাকে দ্রুত কনভিন্স করে ফেলে এবং সামান্য সময়ের ব্যবধানে তার সঙ্গে ফেসবুক আইডি শেয়ার করি। এমনকি মোবাইল নাম্বার আদান-প্রদান হয়।
ভুক্তভোগী জানান, ‘এরপর একদিন বাবা-মা’র সঙ্গে পরিচয় করে দেওয়ার কথা বলে দিনাজপুর শহরে ষষ্ঠীতলা রোডের বাসায় নিয়ে যায়। সরল বিশ্বাসে ওর বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ওর বাবা-মা বাসায় নেই। জিজ্ঞাসা করলাম-তুমি না বাবা-মা’র সঙ্গে পরিচয় করে দিবা, তারা কই? বলল তারা বাইরে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। তুমি জুস খাও। তাদের আসতে দেরি হলে তুমি চলে যেও। কিন্তু বিশ্বাস করে ভদ্রতার খাতিরে ওই জুস খাওয়ার পর আর কিছু বলতে পারিনি। এরপর চেতনা ফিরে এলে নিজেকে ভিন্ন এক চেহারায় আবিষ্কার করি। বুঝতে পারি আমার সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। এ কথা বলতে বলতেই কাঁদতে থাকেন এই তরুণী।
এরপর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি বলেন, তার কাছ থেকে ব্যবসায় পার্টনার করার কথা বলে ইতোমধ্যে অর্ণব সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। এছাড়া সম্ভ্রম হারানোর পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ১০ লাখ টাকাও নিয়ে গেছেন অর্ণব। এই কষ্টটা আসলে আর সহ্য করতে পারছি না। ওদিকে লোকলজ্জার ভয়ে মামলাও করতে পারিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভা-আদ্যাক্ষরের এক মেয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে আমি তাকে ফোন দিই। তিনি তখন জানান, একইভাবে সেও তার মতো ভুক্তভোগী। তার কাছ থেকেও গাড়িসহ প্রায় ৮০ ভরি স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছে অর্ণব। তিনি জানান, আমরা সবাই মানুষ নামের এই নরপশুটার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে বাকিরাও তাদের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রায় একই রকম বর্ণনা দেন। কাউকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছেন লং ড্রাইভে, কাউকে দাওয়াত দিয়ে একরকম জোর করে তার রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসেন। এরপর প্রত্যেককে ছলেবলে কৌশলে বাসায় নিয়ে যান। তারপর একই নাটক। বাবা-মা বাসায় নেই। বাইরে আছেন। একটু পরেই চলে আসবে। জুস কিংবা কফি খাওয়ার অফার করা হয়। তারপর অজ্ঞান করে ধর্ষণ এবং নগ্ন শরীরের ভিডিও ধারণ। জ্ঞান ফিরলেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। ভিডিও দেখিয়ে ফের ধর্ষণ এবং মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজি।
মামলা : তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত অর্ণব দুটি ধর্ষণ মামলার আসামি। ২০২২ সালের ৩০ মার্চ- ন’- আদ্যাক্ষরের ভুক্তভোগী দিনাজপুর সদর থানায় মামলা করেন। মামলা নং জিআর ১৯০/২২। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আল হেলাল অর্ণবের বিরুদ্ধে এই মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ন- আদ্যাক্ষরের তরুণীর মামলায় দিনাজপুরে কারাগারে থাকাবস্থায় ধানমন্ডির আরেক ভুক্তভোগী তরুণী মামলা করে। তার কাছে অর্ণবের আসল পরিচয় তখনও ধরা পড়েনি। বিবস্ত্র অবস্থায় স্থানীয় লোকজন ভিকটিমকেসহ পুলিশের হাতে সোপর্দ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি ভাইরাল হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল তিনিও দিনাজপুর সদর থানায় মামলা করেন। দিনাজপুর সদর থানার মামলা নং-জিআর ২০৪/২০২২। অবশ্য ওই সময় পর্যন্ত অর্ণবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন ই’- আদ্যাক্ষরের এই তরুণী।
এদিকে এই দুই মামলায় চার মাস জেল খেটে উচ্চ আদালতের জামিন আদেশে ছাড়া পান অর্ণব।
ওই তরুণীর অভিযোগে আরও বলা হয়, পরিচয়ের পর প্রেমের সম্পর্ক করে বিয়ের প্রলোভনে তাকে ধর্ষণ করেন অর্ণব। বিয়ের কথা বলে তার কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা, ৫০ ভরি স্বর্ণালংকার ও দুটি প্রাইভেট কার হাতিয়ে নেন। অর্ণব তার কাছ থেকে সব মিলিয়ে প্রায় এক কোটি ২৭ লাখ টাকার জিনিসপত্র নিয়েছেন বলে দাবি করেন ওই তরুণী। ধর্ষণের সময় অর্ণব তার মোবাইলে ভিডিও ধারণ করে রাখে। সিআইডির ফরেনসিক রিপোর্টে ভিডিও ধারণের সত্যতা পায় পুলিশ। জানা গেছে, এ মামলায় চার্জশিট দিয়েছে দিনাজপুর সদর থানার পুলিশ। ২০২২ সালের ৩১ জুলাই এই মামলার চার্জশিট দাখিল করেন মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. নুর আলম।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, দিনাজপুরের গণেশতলায় বনানী মার্কেটে যে ফ্লোর ভাড়া নিয়ে রেস্টুরেন্ট খুলেছিল অর্ণব ওই মার্কেটের মালিকও তার বিরুদ্ধে জবরদখলের অভিযোগ এনে প্রতারণার মামলা করেন। ২০২২ সালের ২২ মার্চ দিনাজপুর সদর থানায় মামলাটি করেন কানিজ তাকবীর-এ ফাতেমা। দিনাজপুর সদর থানার মামলা নং ৬০।
দিনাজপুর জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তাও অর্ণবের আমলনামা নিয়ে বিস্ময়কর সব তথ্য দেন। তিনি বলেন, তার পিতা ইন্সপেক্টর মো. জাহিদুল ইসলামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলায়। তার শ্বশুরবাড়ি দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ঢেলপীর বাজারের তেঁতুলতলা গ্রামে। সেই সূত্র ধরে অর্ণব ২০২১ সাল থেকে দিনাজপুরে ‘লিগ্যাসি’ নামে চায়নিজ রেস্টুরেন্ট খোলেন। সেই থেকে তার প্রতারণার ডালপালা মেলতে থাকে। এই অর্ণবকে অনুসরণ করেছেন এমন একজন পুলিশ সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ছেলেটি বিকৃত মানসিকতার। তার পিতার অপরাধের রেকর্ডও ছাড়িয়ে গেছে পুত্র।
অর্ণবের এক বন্ধু যুগান্তরকে বলেন, প্রথমে দিনাজপুরে রেস্টুরেন্ট খোলার আগেই এলাকার আর্থিকভাবে সচ্ছল তরুণ-তরুণীদের নাম-পরিচয় ও তাদের নাম্বার সংগ্রহে লোক লাগিয়ে দেয় এই অর্ণব। এরপর জেলার তরুণ-তরুণীদের একটি আড্ডাখানায় পরিণত হয় রেস্টুরেন্ট ‘লিগ্যাসি’। ছেলে অর্ণবের চেয়ে বাবাও কম যান না। তার বাবা ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও রয়েছে এন্তার অভিযোগ। পুলিশে চাকরি দেওয়া ও বিদেশে পাঠানোর কথা বলে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। চারজন ভুক্তভোগী প্রতিবেদকের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাহমাতুর রাফসান অর্ণবের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
প্রসঙ্গত, রাফসানের পিতা জাহিদুল ইসলাম ১৯৯১ সালে এসআই পদে যোগ দেন। ২০১৫ সালে তিনি ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান। সাড়ে ৩২ বছরের চাকরি জীবনে প্রায় অর্ধশতবার বিভাগীয় তিরস্কারের মুখোমুখি হন, যার রেকর্ড তার সার্ভিস বুকে সংরক্ষিত আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্ণবের পিতা ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘ছেলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। আমার কাছেও কিছু রেকর্ডপত্র আছে। শুরুই হয়েছে একটি মিথ্যা দিয়ে। আমি শুধু এতটুকুই বলব। আদালতের কাছেও বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার। তিনি দাবি করেন, ‘আমার ছেলের বিরুদ্ধে যেমন মামলা করা হয়েছে, তেমনি আমাদেরও মামলা আছে। অর্ণব ষড়যন্ত্রের শিকার!’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছ থেকে চাকরি বা বিদেশে লোক পাঠানোর নামে টাকা নেইনি।’