ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাই
মামলার তদন্ত থমকে আছে এক বছর
এখনো গ্রেফতার হয়নি ৩ ডাকাত, উদ্ধার হয়নি ৩ কোটি টাকা * মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি-ডিসি, ডিবি
সিরাজুল ইসলাম
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর উত্তরার তুরাগে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সোয়া ১১ কোটি টাকা ছিনতাইয়ের তদন্ত থমকে আছে ১ বছর ধরে। চাঞ্চল্যকর ওই ছিনতাইয়ের ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সন্দেহজনকভাবে সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। ওইদিনই উদ্ধার করা হয় তিন কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। পরে কয়েকদিন ওই ঘটনাটি ছিল ব্যাপক আলোচনায়। ওই সময় সিরিজ অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ১৩ জনকে। এদের মধ্যে ১২ জনই নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
এছাড়া পরে বেশ কয়েকটি অভিযানে ওই সময় উদ্ধার করা হয় আট কোটি ১০ লাখ ৫ হাজার ৫০০ টাকা। এরপর ১ বছরের বেশি সময় ধরে মামলাটির তেমন অগ্রগতি নেই। এখনো ঘটনায় জড়িত মোস্তফা এবং জনিসহ তিন ডাকাতকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার হয়নি তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা। তিন আসামিকে গ্রেফতার করতে না পারা এবং ছিনতাইকৃত বাকি টাকা উদ্ধার না হওয়াতেই তদন্ত আটকে আছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানতে চাইলে ডিবির উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাই হওয়া বেশিরভাগ টাকা আমরা উদ্ধার করেছি। বাকি টাকা উদ্ধার ছাড়া আমরা চার্জশিট দিতে চাচ্ছি না। দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আমাদের কার্যক্রম চলছে। এ পর্যন্ত যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলো- হৃদয়, সাগর মাদবর, ইমন ওরফে মিলন, সানেয়ার হাসান, বদরুল আলম, আকাশ মাদবর, এনামুল হক বাদশা, মিজানুর রহমান, সনাই মিয়া, মিলন, সোহেল, হাবির এবং বাবলু।
৯ মার্চ রাজধানীর উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। মানিপ্ল্যান্ট লিংক লিমিটেডের গাড়িতে করে ওই টাকা বহন করা হচ্ছিল। গাড়িটি বুথে টাকা লোড করতে ঢাকা থেকে সাভার ইপিজেড যাচ্ছিল। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তুরাগ এলাকায় সশস্ত্র ছিনতাইকারীরা বন্দুকের মুখে গাড়িতে থাকা টাকার চারটি ট্রাংক ছিনতাই করে। এ ঘটনায় মানিপ্ল্যান্টের পক্ষ থেকে তুরাগ থানায় একটি মামলা করা হয়। মামলাটির তদন্তভার পায় ডিবির মিরপুর বিভাগ। জানতে চাইলে মানিপ্ল্যান্ট লিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি যশোদা জীবন দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, ছিনতাই হওয়া সোয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে আট কোটি টাকা পেয়েছি। বাকি টাকা এখনো পাইনি। মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত ১ বছরে কী অগ্রগতি হয়েছে তা আমি জানি না। এই দীর্ঘ সময়ে তদন্ত সংস্থা-ডিবির পক্ষ থেকে আমাকে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
তিনি বলেন, টাকাটা ছিল ব্যাংকের। আমরা শুধু বাহক হিসাবে সেটি বুথে নিয়ে যাচ্ছিলাম। ছিনতাই হওয়া পুরো টাকা জোর করে ব্যাংক আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাকি টাকা উদ্ধার করতে পারেনি। আমি এখন বিপদে আছি। খুবই কষ্টে আছি। মনের দুঃখে এখন ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দিতে চাচ্ছি। তিনি বলেন, ঘটনার পর মাসখানেক বিষয়টি আলোচনায় ছিল। পরে সবাই ভুলে গেছে। ডিবিও চুপ হয়ে গেছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী সিকিউরিটি এজেন্সি মানিপ্ল্যান্ট লিংক লিমিটেডের সাবেক গাড়িচালক সোহেল। তার সঙ্গে পরিকল্পনায় ছিল আকাশ ও সানোয়ার। অন্যরা সরাসরি ছিনতাইয়ে অংশ নেয়। ছিনতাইয়ের কবলে পড়া গাড়ির নকল চাবি ছিল ডাকাতদের কাছে। ওই চাবির মাধ্যমে সুইচ টিপে গাড়ির দরজা খোলে ডাকাতরা।
সোহেল রানা আগে মানিপ্ল্যান্ট লিংক লিমিটেডের গাড়িচালক ছিল। এ কারণে সে মানিপ্ল্যান্টের খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানত। তাই অনেকটা বাধাহীনভাবেই তারা মাইক্রোবাসটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। ডাকাতিতে অংশগ্রহণকারীদের সুনামগঞ্জ, সিলেট, নেত্রকোনা, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল থেকে আনা হয়।
সূত্র আরও জানায়, টাকা লুটের পরিকল্পনা নিয়ে ইমন ওরফে মিলনের সঙ্গে আলোচনা করে আকাশ। সে মিলনকে বলে, হুন্ডির টাকা ধরতে হবে। এজন্য কিছু লোক প্রয়োজন। আমাদের সঙ্গে প্রশাসনের লোকজন থাকবে। মিলন তার পূর্বপরিচিত সানোয়ার হোসেনকে বিষয়টি জানায়। তাকে জনবল ও সিম সংগ্রহ এবং মোবাইল ফোন কেনার দায়িত্ব দেয়। সানোয়ার আটটি নতুন সিম ও মোবাইল সেট জোগাড় করে। পাশাপাশি তার নিজ জেলা সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা থেকে ৯ জনকে সংগ্রহ করে। তারা প্রত্যেকে ঘটনার দুদিন আগে ঢাকায় একত্রিত হয়। পরিকল্পনাকারীরা তাদের নতুন কাপড় ও জুতা কিনে দেয়। আকাশ ও সোহেল রানা ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের টাকা লুটের বিষয়টি গোপন রাখে মিলন ও সানোয়ারের কাছে। ঘটনার দিন সবাই কুর্মিটোলায় একত্রিত হয়। মাইক্রোবাসে ওঠার পর মিলন ও সানোয়ার বুঝতে পারে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ডাকাতির ঘটনায় কয়েক স্তরে বিভিন্নজনের আলাদা দায়িত্ব ছিল। কেউ ছিল পরিকল্পনাকারী, কেউ মোবাইল ও সিম সংগ্রহকারী, কেউ ছিল লোক সংগ্রহকারী।