তীব্র তাপদাহে গর্ভের সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন অন্তঃসত্ত্বারা
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
দেশজুড়ে তীব্র তাপপ্রবাহে হাঁসফাঁস জনজীবন। তবে এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা। গরমে অন্তঃসত্ত্বা অনেক মা বুক ধড়ফড় করা, মাথাব্যথা, অসংলগ্ন কথা বলা বা বমি, হিট স্ট্রোকের মতো উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। এসব লক্ষণে মৃত সন্তান প্রসব ও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ছে। অন্যদিকে শিশুদের ডায়রিয়া, জ্বর, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের অসুস্থতা বাড়ছে। সরেজমিন রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে সেখানে চিকিৎসা নিতে আসা অন্তঃসত্ত্বা মা এবং শিশু রোগীর অভিভাবক ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলমান তাপপ্রবাহ সহসা কমছে না। এপ্রিল মাস জুড়েই এই অবস্থা থাকতে পারে। বরং তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। বুধবার চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, তীব্র্র গরমে সবচেয়ে বেশি হিট স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছে নবজাতক, শিশু, গর্ভবতী নারী। গরমে শ্রমজীবী মানুষ, বয়স্ক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি, চিকিৎসাধীন রোগী ও অতিরিক্ত ওজনের মানুষের ঝুঁকি বাড়ছে।
তীব্র গরমে অসুস্থ হয়ে বুধবার মিরপুরের লালকুঠি এলাকায় ২০০ শয্যাবিশিষ্ট মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শিল্পী খাতুন। সঙ্গে থাকা তার বোন শিউলি আক্তার জানান, ৬ মাসের গর্ভবতী শিল্পী অতিরিক্ত ঘামে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। এ কারণে দ্রুত ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. রতন কুমার আগরওয়ালা বলেন, ‘প্রতিদিনই রোগীর চাপ বাড়ছে। বহির্বিভাগে ২০০ বেশি রোগী আসছে। শারীরিক অসুস্থ বিবেচনায় জরুরি ও বহির্বিভাগে আসা অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের ২০ ভাগকেই ভর্তির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’ জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে শিশু রোগীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ২৬০ জন মা ও শিশু ভর্তি রয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত এক সপ্তাহে দৈনিক হাসপাতালে ৭০০ থেকে ৮০০ জন অসুস্থ মা ও শিশু চিকিৎসা নিতে আসছেন। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. আব্দুল মান্নান যুগান্তরকে বলেন, গরমে গর্ভবতী মায়েদের পানিশূন্যতা, বুক ধড়ফড় করা, মাথাব্যথা, বমির মতো উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে। শিশুরা জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে বেশি আসছে।
মিরপুর ১৩ নম্বরের ওজিএসবি অ্যান্ড আইআরসিএইচ হাসপাতালেও রোগীর ভিড় দেখা যায়। প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. বিউটি রানী বলেন, বহির্বিভাগে গর্ভবতী নারী ও শিশু রোগীর চাপ বেড়েছে। রোগীদের বেশিরভাগই ভাইরাস জ্বর, পানির স্বল্পতা ও রক্তচচাপ কমে যাওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন।
অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা যুগান্তরকে বলেন, ‘তীব্র গরমে অন্তঃসত্ত্বাদের অতিরিক্ত পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানিশূন্যতা থেকে ‘হিট এক্সোশন হয়ে অল্পতেই অতিরিক্ত দুর্বলতা ও ক্লান্তিবোধ হতে পারে। গরমের তীব্রতা বেশি হলে হিট স্ট্রোকের মতো জটিলতা হওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। মাথা ঘোরাতে পারে, অচেতন হয়ে যেতে পারে। এ সময় নাড়ির স্বাভাবিক গতি বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় নাড়ির স্পন্দন প্রতি সেকেন্ডে ৮০ বার হয়ে থাকে। অতিরিক্ত গরমে নাড়ির স্পন্দন ১০০ থেকে ১২০ হয়ে যেতে পারে। হিট স্ট্রোক হয়ে গর্ভাবস্থায় বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।’
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম বলেন, ‘পানিশূন্যতার কারণে গর্ভবতীর শরীরে হিট ক্র্যাম্প হতে পারে। অতিরিক্ত ঘামের জন্যও ক্র্যাম্পিং হতে পারে। হিট ক্র্যাম্প প্রথমে হাত-পায়ে হয়। জরায়ুতে বাচ্চা থাকা অবস্থায় কিছুক্ষণ পরপর জরায়ু সংকুচিত হয়, আবার ছেড়ে দেয়, যেটাকে ব্র্যাক্সটন হিক্স কন্ট্রাকশন বলা হয়। গর্ভাবস্থায় নয় মাস ধরেই এমনভাবে পেট শক্ত থাকে। কিন্তু তীব্র গরমে শক্তভাব বেড়ে যায়।’
এছাড়া তীব্র পানিশূন্যতার কারণে অনেক সময় জরায়ুতে ইডিমা হয়ে যায়, অর্থাৎ সেখানে পানি জমে যেতে পারে। যে কারণে জরায়ু থেকে হালকা রক্তপাত হতে পারে। বেশি রক্তপাত হলে বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে, বাচ্চা নড়াচড়া কমিয়ে দেয়। মায়ের পানিশূন্যতা হলে বাচ্চারও পানিশূন্যতা হবে।’
প্রসূতি চিকিৎসকরা জানান, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে গরমে দৈনিক ২-৩ লিটার বা ৮ থেকে ১৫ গ্লাস পানি অবশ্যই পান করতে হবে। নিয়মিত গোসল করতে হবে। গোসলের সময় পানির তাপমাত্রা যেন স্বাভাবিকের নিচে থাকে, তা খেয়াল রাখতে হবে। হালকা রঙের, ঢিলেঢালা আরামদায়ক পোশাক পরতে হবে। ফল, সবজি, সালাদ খেতে হবে।
তাপপ্রবাহে অতি উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে শিশুরা-ইউনিসেফ : এদিকে তাপপ্রবাহের মধ্যে শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটি শিশুদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ইউনিসেফের ২০২১ সালের শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে (সিসিআরআই) বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অতি উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে। এক বিবৃতিতে ইউনিসেফ বলেছে, অতিরিক্ত তাপমাত্রা শিশুদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। বিশেষ করে, নবজাতক, সদ্যোজাত ও অল্পবয়সি শিশুরা হিট স্ট্রোক ও পানিশূন্যতাজনিত ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, চলমান তাপপ্রবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। তাপপ্রবাহ থেকে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সুরক্ষার জন্য ইউনিসেফ বাবা-মা, পরিবার, পরিচর্যাকারী ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সেগুলো হলো-শিশুরা যেখানেই থাকুক না কেন তাদের বসা ও খেলার জন্য ঠান্ডা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি কোনো শিশু বা অন্তঃসত্ত্বা নারীর মধ্যে ‘হিট স্ট্রেস’ বা তাপমাত্রাজনিত সমস্যার উপসর্গ দেখা দেয় (মাথা ঘোরা, অতিরিক্ত ঘাম, বমি বমি ভাব, হালকা জ্বর, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, মাংসপেশিতে টান, ডায়াপার পরার জায়গাগুলোতে ফুসকুড়ি) তাহলে তাকে একটি ঠান্ডা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এরপর ভেজা তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিতে হবে বা গায়ে ঠান্ডা পানি দিতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি বা খাবার স্যালাইন পান করাতে হবে। তবে হিট স্ট্রেসের (তাপমাত্রাজনিত অসুস্থতার) উপসর্গ তীব্র হলে (সাড়া না দিলে বা অজ্ঞান হয়ে পড়লে, তীব্র জ্বর, হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলে, খিঁচুনি দেখা দিলে এবং অচেতন হয়ে পড়লে) সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতে হবে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, উত্তরা পশ্চিম ও মোহাম্মদপুর প্রতিনিধি।