‘অপারেশন আটলান্টা’র সতর্কবার্তা
মুক্তিপণে আরও বাড়তে পারে জলদস্যুতা
মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ ছাড়িয়ে আনা চূড়ান্ত সমাধান নয়-শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি * এমভি আব্দুল্লাহর ২১ নাবিক জাহাজে ফিরবেন
মজুমদার নাজিম উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পণ দিয়ে জাহাজ মুক্ত করে আনার প্রবণতা ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ এবং ভারত মহাসাগরে জলদস্যুতার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে-এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জলদস্যুতা প্রতিরোধে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পরিচালিত ‘অপারেশন আটলান্টা’। ১৫ এপ্রিল সোমালিয়া উপকূলে দস্যুতার হুমকি সম্পর্কিত অপারেশন আটলান্টার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে জাহাজ শিল্পসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, মুক্তিপণ পেয়ে উৎসাহিত হয়ে আগের চেয়ে আরও বেশি চড়াও হতে পারে সোমালি জলদস্যুরা। তাদের মতে, সোমালিয়া উপকূলে বেশ কয়েকটি জলদস্যু গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। একবার কোনো গ্রুপ মুক্তিপণ আদায়ে সফল হলে অন্য গ্রুপগুলো তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়।
একই প্রক্রিয়ায় অর্থ আদায়ের লোভে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। বেশ কিছুদিন বিরতির পর সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই বেড়ে গেছে সোমালি জলদস্যুদের উৎপাত। তার ওপর তারা মুক্তিপণ পেতে থাকলে দস্যুতার একটা ঢেউ উঠতে পারে, যেমনটি দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালের দিকে। ওই সময় সোমালি জলদস্যুরা অসংখ্য বাণিজ্যিক জাহাজ ছিনতাই করে আদায় করেছিল বিপুল অঙ্কের মুক্তিপণ।
১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। এর ৩২ দিন পর ১৪ এপ্রিল এটি দস্যুদের কব্জা থেকে মুক্তি পায়। রয়টার্সসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বাংলাদেশি ৫৫ কোটি টাকা সমমানের মুক্তিপণ পাওয়ার পর দস্যুরা জাহাজ ও এর ২৩ নাবিককে ছেড়ে দেয়।
অবশ্য জাহাজের মালিকপক্ষ চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং মুক্তিপণের বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
জাহাজটি আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাচ্ছিল। ছিনতাইয়ের পর দস্যুরা জাহাজটিকে সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যায়। সেখান থেকেই দেওয়া হয় মুক্তি। জাহাজটি বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথে রয়েছে। ২২ এপ্রিল এটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে পৌঁছবে। সেখানে কয়লা খালাস করে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওয়ানা দেবে।
এদিকে জাহাজের ২৩ নাবিকের ২১ জনই ওই জাহাজে দেশে ফেরার আগ্রহ দেখিয়েছেন। অপর দুজন ফ্লাইটে দেশে আসতে চান। জাহাজের মালিকপক্ষ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জাহাজটি দেশে এসে পৌঁছাতে আরও প্রায় ১ মাস সময় লাগতে পারে। যে দুজন ফ্লাইটে দেশে ফিরতে চান তারা হলেন জেনারেল স্টুয়ার্ড মোহাম্মদ নুর উদ্দিন ও সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মোজাহেদুল ইসলাম।
১৫ এপ্রিল প্রকাশিত অপারেশন আটলান্টার প্রতিবেদনে সোমালিয়ার উপকূলে জলদস্যুতার হুমকি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘যদিও গত ৭ দিনে কোনো জলদস্যুতা-সম্পর্কিত ঘটনা ঘটেনি, তবে মুক্তিপণের অর্থ প্রদান পণ্যবাহী নৌযান ছিনতাইয়ে একটি নতুন তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। যার ফলে তারা ভবিষ্যতে এমভি (মোটর ভেসেল) ইত্যাদিতে ছোট নৌযান থেকে আক্রমণ করবে।’
‘অপারেশন আটলান্টা’ সোমালি উপকূলে প্রবেশ করার আগে জাহাজগুলোকে উচ্চতর সতর্কতা ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছে। বেস্ট ম্যানেজমেন্ট প্র্যাকটিসেস ভার্সন ৫ (বিএমপিএস ৫) মেনে চলার অনুরোধ করেছে। বিশেষ করে পূর্ব ভারত মহাসাগর এবং এডেন উপসাগরে সোমালি উপকূলের ৭০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে এ ধরনের সতর্কতা বজায় রাখতে বলা হয়েছে।
মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ ছাড়িয়ে আনা চূড়ান্ত সমাধান নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ। তিনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সোমালিয়ার আশপাশে জলদস্যুপ্রবণ এলাকা দিয়ে চলাচলের সময় জাহাজ যেন আক্রমণের শিকার না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। একবার জাহাজ জলদস্যুদের দখলে চলে গেলে তা মুক্ত করা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে দুটি উপায় থাকে। একটি হলো অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধার করা, অন্যটি মুক্তিপণ।
সম্প্রতি ভারতীয় নৌবাহিনী এমভি রুয়েন নামের একটি জাহাজ অভিযানের মাধ্যমে মুক্ত করেছে। বাংলাদেশি পতাকাবাহী এমভি আবব্দুল্লাহতেও অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু নাবিকদের সম্ভাব্য ক্ষতির দিকটি চিন্তা করে সেই অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, জাহাজে গানম্যানসহ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখতে হবে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন মো. আনাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সোমালিয়ান জলদস্যুরা ৩৫৮টি জাহাজ ছিনতাই করেছিল। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। তাই অনেকে জলদস্যুতাকেই পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন আর জাহাজ ছিনতাই তাদের পক্ষে সহজ হবে না। কেননা ওই অঞ্চলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নেভাল ফোর্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৌবাহিনী সক্রিয় রয়েছে।