এফবিসিসিআই-এনবিআর পরামর্শক সভা
গ্যাস বিদ্যুৎ ডলার সংকটে ভুগছে শিল্প খাত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি আর ডলার সংকটে পর্যুদস্ত দেশের শিল্প খাত। তার ওপর কর ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানও ব্যবসাবান্ধব নয়। প্রতি মাসে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদহার। এসব কারণে চলতি বছরেই অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাই শিল্প মালিকরা ব্যবসা থেকে বেরিয়ে আসতে এক্সিট পলিসি চান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে এফবিসিসিআই-এনবিআর আয়োজিত ৪৪তম পরামর্শক সভায় তারা এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান। সভা সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম।
স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, রাজনীতি যার যার, অর্থনীতি সবার। অর্থনীতি ঠিক থাকলে দেশ ঠিক থাকবে। ব্যবসায়ীরা অনৈতিক কিছু চান না, তারা চান ব্যবসা সহজ করা হোক। কর্মসংস্থানবান্ধব ও বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন করা হোক। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়করের হয়রানি আছে। এগুলো সংস্কারের মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব নীতি দেওয়া হোক।
মুক্ত আলোচনা : বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ব্যবসায়ীরা ভালো নেই। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, তারপরও ক্রমান্বয়ে দাম বাড়ানো হচ্ছে। ঋণের সুদহার ডাবল ডিজিটে পৌঁছেছে, ডলার সংকট, ইডিএফ ফান্ড সংকুচিত করা হয়েছে। অনেক ব্যাংক ইডিএফ দিচ্ছে না। সব মিলিয়ে রপ্তানি খাত পর্যুদস্ত। ডলার আয়কারী এ খাতকে প্রতিবন্ধকতার দিকে ঠেলে দিয়ে আগামীতে ডলার সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের টাকা লুণ্ঠনকারীদের বিচার করুন। তাদের বোঝা সৎ ব্যবসায়ীদের ওপর চাপিয়ে দেবেন না। সত্যিকারের ব্যবসায়ী- যারা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছেন, রাজস্ব দিয়েছেন, কিন্তু ডলার সংকট-গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত তাদের জন্য এক্সিট পলিসি করে দেওয়া হোক। পৃথিবীর সব দেশেই এ নিয়ম আছে।
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের কর ব্যবস্থা বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিপন্থি। যেমন শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আদায় করা হয়, রিটার্ন জমার সময় সেই অগ্রিম কর সমন্বয় করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, প্রতি মাসে ঋণের সুদহার বাড়ছে। ব্যাংকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। গত এক বছর ধরে ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করছে না, ব্যাংকগুলো ডলার ব্যবসা করতে চায়। এই ব্যবসা করতে গিয়ে ব্যাংকগুলো আমদানি-রপ্তানিকারকদের বিশাল ক্ষতি করছে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, নগদ সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে, ক্রেতারা পণ্যের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। এতকিছুর পর টিকে থাকা কঠিন। এ বছর অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে।
রিকন্ডিশন গাড়ি আমদানিকারক সমিতির (বারভিডা) সভাপতি হাবিব উল্লাহ ডন বলেন, ব্যবসায়ীরা যথেষ্ট কষ্টে আছেন, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ডলার সংকট, টাকার অবমূল্যায়ন ও সুদহার বেড়ে যাওয়ায় গাড়ি আমদানির খরচ ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই গাড়ি মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
স্টিল মিল মালিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাসাদুল আলম বলেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্টিল শিল্পের কাঁচামাল আমদানি প্রায় বন্ধের পথে। তার ওপর দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে নতুন বিনিয়োগ আসবে কী করে?
গাজীপুর চেম্বারের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাংলাদেশে এক ভরি স্বর্ণের দাম ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা, আর সিঙ্গাপুরে ৮৬ হাজার টাকা। অথচ সিঙ্গাপুরে একটি দোকান ভাড়া ১০ লাখ টাকা ও একজন কর্মচারীর বেতন ৪০ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশে দোকান ভাড়া ৫০ হাজার বা এক লাখ টাকা এবং কর্মচারীর বেতন ১০ হাজার টাকা। তাহলে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম এত বেশি কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়বে। মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার অ্যান্ড মেনুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মতিউর রহমান বলেন, দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। বাড়তি দামেও গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার এলপিজি দিয়েও কারখানা চালানো সম্ভব নয়। শিল্পে গ্যাস-বিদ্যুৎ দিলে সরকার যত রাজস্ব চায়, ব্যবসায়ীরা তা দিতে পারবে।
মেট্রোপলিটন চেম্বারের (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমানো হলেও শিল্প সেই সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। নগদ লেনদেনের শর্ত জুড়ে দেওয়ায় অনেক কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠানকেও আগের হারে করপোরেট কর দিতে হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশ অনানুষ্ঠানিক। তাই বাধ্য হয়ে কমপ্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠানকেও নগদে লেনদেন করতে হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অব্যাহতির সুবিধা অবারিত করে দিতে পারি না। কারণ এনবিআরকে রাজস্ব আদায় করতে হয়। সবাই বলে দেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম, আবার সবাই কর অব্যাহতি সুবিধা চায়। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, কর ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে দাতা সংস্থার চাপ রয়েছে। তাই শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেন, বাজেটের কার্যক্রম চলমান আছে। ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবি বিবেচনা করা হবে।
করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৪ লাখ করার প্রস্তাব : মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, রপ্তানি উৎসে কর হ্রাস করাসহ ৩৮১টি প্রস্তাব দিয়েছে এফবিসিসিআই। এছাড়া রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতায় টিকে থাকতে নগদ সহায়তার বিকল্প হিসাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও পরিবহণ খাতে প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।