কালিয়াকৈরে গ্যাসের আগুন : মৃত্যু বেড়ে ২
ঘোর কাটছে না স্বজনদের
আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২৯ * ৫০-৮০ শতাংশ পোড়া রোগীই বেশি
শিপন হাবীব
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ওয়ার্ড থেকে আইসিইউজুড়ে ছোটাছুটি স্বজনদের। স্বজনরা কখনও বারান্দায়, কখনও কাচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছেন, দগ্ধ প্রিয় মানুষটি কেমন আছে। সঙ্গে বাড়ছে হা-হুতাশ।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই দগ্ধ ব্যক্তিদের লাশ বের হচ্ছে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে।
শনিবারও মনসুর আকনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার মারা গেছেন সোলায়মান মোল্লা। এখনও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ২৯ জন। যাদের ৫০-৮০ শতাংশ শরীর পুড়ে গেছে। আইসিইউতে রয়েছেন ৯ জন।
শনিবার সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক ডা. হোসাইন ইমাম ইমু যুগান্তরকে জানান, গাজীপুরে অগ্নিকাণ্ডে ভর্তি ৩২ জনের মধ্যে ২ জন মারা গেছেন। শনিবার সকালে মনসুর নামে এক ব্যক্তি, শুক্রবার মারা গেছেন সোলায়মান মোল্লা। একজন চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে গেছেন।
বর্তমানে সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন ২৯ জন। এদের মধ্যে ২-৩ বছরের ফুটফুটে শিশুও রয়েছে। চিকিৎসক থেকে নার্স, হাসপাতালের কর্মী সবাই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় সেবা দিচ্ছেন।
ডা. হোসাইন বলেন, অন্তত ১৯ জনের অবস্থা খুবই খারাপ। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। বিশ্বমানের সাপোর্টও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, দগ্ধদের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে, অনেককেই বাঁচানো সম্ভব হবে না। অনেকেই শতভাগ পোড়া শরীর নিয়ে ভর্তি আছেন। যাদের মধ্যে নারী এবং শিশুও রয়েছে।
তিনি বলেন, সচেতনতা ছাড়া এমন ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, এমন ভয়াবহতায় আমরা সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। চিকিৎসাধীন অবস্থায় অনেকের মৃত্যু হয়। ১০ শতাংশ পুড়ে গেলে যেখানে মৃত্যুর ভয় থাকে-সেখানে ৫০-৮০ শতাংশ পোড়া ব্যক্তিই বেশি।
মৃত মনসুরের বড় ভাই আবু জাফর জানান, তার ভাই মনসুর আকন সাধারণ শ্রমিক, রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। তারা খুবই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। যেদিন দুর্ঘটনা সেইদিন কাজ শেষে রাস্তা ধরে বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ বিকট শব্দে তার শরীরেও আগুন লাগে।
ভাইয়ের কি অপরাধ ছিল, এমন প্রশ্ন উগরে দিয়ে বললেন, ‘এমন ভয়াবহ মৃত্যুর দায় কে নেবে। কে ক্ষতিপূরণ দেবে। এমন মৃত্যু তো সরাসরি খুনের শামিল। তার স্ত্রীসহ দুটি শিশু সন্তান আছে। এখন তাদের কী হবে। কে তাদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করবে। আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে থাকা মহিদুলের পাশের বেডেই ভর্তি তার স্ত্রী নার্গিস আক্তার। দুজনের শরীর পুড়ে গেছে ৮০ শতাংশ।
নার্গিস আক্তারের বাবা জানালেন, আমার মেয়ে এবং মেয়ের জামাইয়ের কী হবে। একই পরিবারের আরও তিনজন দগ্ধ হয়ে এইচডিইউতে ভর্তি। তাদের শরীরও পুড়ে গেছে ৮০ শতাংশ। একবার আইসিইউ আবার এইচডিইউ’র সামনে দৌড়াচ্ছি। কিছুতেই শঙ্কা কাটছে না। বের হওয়া লাশ দেখে বারবারই আঁতকে উঠছেন।
অধ্যাপক প্রদীপ চন্দ্র দাস জানান, আমরা (চিকিৎসক) সর্বোচ্চ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছি। সেবা প্রদান করছি। অতিরিক্ত লোকবলও কাজ করছে। আইসিইউসহ বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন দগ্ধরা। চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা দগ্ধদের স্বজনদেরও কোনো আশার বাণী শোনানো যাচ্ছে না।
বুধবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচলা এলাকায় শফিকুল ইসলামের ঘরে সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে যায়। পাশের একটি দোকান থেকে নিজেই একটি গ্যাস সিলিন্ডার কিনে এনে ঘরের ভেতরে চুলার সঙ্গে সংযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় সিলিন্ডারের চাবি ভেঙে যায়। এতে গ্যাস ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন তিনি সিলিন্ডারটি বাইরে ফেলে দেন। ফেলে দেওয়ার পরও সিলিন্ডার থেকে গ্যাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় পাশের অন্য একটি ঘরের লাকড়ির চুলার আগুন গ্যাসের সংস্পর্শে এলে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। আশপাশের ঘরে ও বাইরে থাকা লোকজনের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে নারী, পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ৩৪ জন দগ্ধ হন।