Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কালিয়াকৈরে দগ্ধ ২৬ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন

ক্ষতিগ্রস্ত সবাই দিনমজুর, না খেয়ে দিন কাটছে স্বজনদের

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কালিয়াকৈরে দগ্ধ ২৬ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন

গাজীপুরের কালিয়াকৈরে সিলিন্ডার গ্যাসের আগুনে দগ্ধদের মধ্যে ২৬ জনের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাদের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই ২৬ জনসহ দগ্ধ অন্যরা এখন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন। এখানে ৩২ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে। তাদের মধ্যে আইসিইউতে ৫ ও এইচডিইউতে ২৩ জন রয়েছেন। বাকি ৪ জন ইউনিটের অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। বুধবার বিকালে কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশের একটি কলোনিতে অগ্নিদুর্ঘটনায় অন্তত ৩৪ জন দগ্ধ হন। তাদের প্রায় সবাই সুবিধাবঞ্চিত মানুষ। কেউ দিনমজুর, কেউ রিকশাচালক, কেউ গার্মেন্ট কর্মী। দগ্ধদের মধ্যে বেশ কয়েজন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে তায়বা আক্তার (২), তৌহিদ (৫), সোলয়মান (৫), সোফিয়া (৮), রাহিম (২) নিলয় (২) ও নিরবের (৭) শরীর ৩২ থেকে ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের কারও কারও মা-বাবাও দগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটে কাতরাচ্ছেন। 

সরেজমিন দেখা যায়, বার্ন ইউনিটের ৭ তলায় এইচডিইউতে ২ বছর বয়সি তায়বা আক্তারের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। হাত-পা নাড়াতে পারছে না। একই ইউনিটে ভর্তি তায়বার বড় ভাই তৌহিদ (৫)। তার শরীরের ৮৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়ায় কোনো কথা বলতে পারছে না ছোট এ দুই শিশু। দুই শিশুর বাবা সজল মিয়া জানান, আগুন আগুন শব্দ শোনার পর দুই শিশু টিনের ঘর থেকে বের হতেই শরীরে আগুন লেগে যায়। মুহূর্তেই সারা শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কথাগুলো বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সংসারে তাদের এ দুটি সন্তানই। এখন তিনি কি করবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না।

তিন কন্যা সন্তানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক হাসপাতাল বারান্দায় বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারছিলেন না। মেয়ে নার্গিসের শরীর ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। মেয়ের স্বামী মহিদুল ইসলামের শরীর পুড়েছে ৯০ শতাংশ। মহিদুলকে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। মেয়ে পোস্ট অপারেটিভে ভর্তি। আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ওরা দুজনই গার্মেন্টে কাজ করত। ২৫ বছর বয়সি মেয়েকে এখন চেনা যায় না। পুরো শরীর পুড়ে গেছে। আর মেয়ের জামাই আইসিইউতে। ওদের কিছু হলে আমার আর বেঁচে থেকে কি হবে।’ শিল্পী আক্তার ও তার দুই ছেলে নিলয় ও নিরবের অবস্থা খুবই খারাপ। শিল্পীর বোন ময়ুরী জানান, শিল্পী তার দুই সন্তান নিয়ে ইফতারি তৈরি করছিল। আগুন আগুন চিৎকার শুনে দুই শিশু ঘর থেকে বের হতেই শরীরে আগুন ধরে যায়। ২০ বছর বয়সি আজিজুল ইসলাম একটি গার্মেন্টে চাকরি করতেন। তার শরীর ৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। আজিজুলের বাবা আব্দুল রফিজ জানান, ছেলে কাজ থেকে বাসায় ফেরার পথে ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হয়। 

এদিকে দগ্ধ সবাই সুবিধাবঞ্চিত। তাদের স্বজনরা হাসপাতালের বারান্দায় দিন-রাত কাটাচ্ছেন। সঙ্গে টাকা-পয়সা নেই। নিদারুণ কষ্টে আছেন তারা। একাধিক স্বজন জানান, আমরা না খেয়ে হাসপাতালে পড়ে আছি। আবার অনেকেই এক কাপড়ে চলে এসেছেন। নিদারুণ কষ্টের মধ্যে আছি আমরা।

বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস জানান, দগ্ধ রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চিকিৎসায় সবকিছু বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। 

চিকিৎসা সহায়তা দেবেন প্রধানমন্ত্রী : বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, ৩২ জন এখন বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নন। দগ্ধদের চিকিৎসায় উচ্চতর একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী রোগীদের জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তা করা হচ্ছে। 

এদিন বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধ রোগীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা বিষয়ে এক বোর্ড সভায় অংশ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, কালিয়াকৈরে দগ্ধদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সার্বিক খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় নিজে বহন করবেন। 

সভায় চিকিৎসকদের কাছ থেকে রোগীদের শারীরিক অবস্থার বিস্তারিত তথ্য নেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তাদের কতজন শিশু, কতজনের অবস্থা বেশি গুরুতর, কতজন আইসিইউ, এইইচডিওতে ভর্তি আছে তার খোঁজ নেন তিনি। সভায় উপস্থিত চিকিৎসকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, ‘দগ্ধদের কষ্ট অনেক। প্রতিটি রোগীকে নিজের পরিবারের সদস্যদের মতো করে চিন্তা করতে হবে। রোগীদের অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমরা কিছু রোগীকে হয়তো বাঁচাতে পারব না, কিন্তু কোনো রোগীর প্রতি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টার যেন কোনোরকম অবহেলা না থাকে এটি নিশ্চিত করতে হবে।’

৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন : কালিয়াকৈর (গাজীপুর ) থেকে প্রতিনিধি জানান, তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশে কলোনি এলাকায় থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কষ্টে হতাশায় অনেকেই নির্বাক। কলোনির ১৮টি রুমের ৫-৭টিতে দু-একজন লোক রয়েছেন। বাকি সবাই স্বজনদের কাছে হাসপাতালে ঢাকায় চলে গেছেন। 

জানা যায়, বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিন কার্য দিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করার কথা জানান জেলা প্রশাসক। 

সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে তেলিরচালা টপস্টার কারখানার পাশে শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ী জমি লিজ নিয়ে কলোনি তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন। অপরিকল্পিতভাবে টিনের বেড়া ও টিনের চালা দিয়ে ১৮টি রুম তৈরি করেছেন। ছোট ছোট ঘরে স্বল্প আয়ের মানুষ বসবাস করেন। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ঘরে সিলিন্ডার গ্যাসে রান্না করেন। যাদের সামর্থ্য নেই তারা ঘরের পাশেই বাইরে মাটির চুলা বানিয়েছেন। সেখানে তারা লাকড়ি দিয়ে রান্না করে থাকেন। বাইরে যেখানে রান্না করা হয় তার পাশ দিয়ে মহাসড়কে থেকে কলোনিতে যাতায়াতের ছোট রাস্তা রয়েছে। ওই রাস্তা দিয়ে লোকজন চলাচল করেন। বড় ধরনের দুর্ঘটনা হলে আশপাশের সব কলোনি পুড়ে যাবে। বাইরে রান্না করতে গিয়েই গ্যাস সিলিন্ডার থেকে হঠাৎ গ্যাস লিকেজ হয়ে আগুন ধরে যায়। উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণেই মূলত কলোনির লোক ছাড়াও আশপাশের অনেকে দগ্ধ হয়েছেন।

এদিকে ক্ষতিগ্রস্তদের সাড়ে ৭ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছে কালিয়াকৈর উপজেলা প্রশাসন। কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কাউসার আহমেদ অনুদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের পরিবারে কাছে অনুদানের টাকা প্রদান করা হয়।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম