কোকেন চোরাচালান
চক্রে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইজেরিয়ান ছাত্র
আদালতে ৬ আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি * প্রতিবেশী একটি দেশে অর্ধশত চালান পাচার
তোহুর আহমদ
প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে কোকেন পাচারে বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাইজেরিয়ান ছাত্র জড়িত। নাম ইজাহা ইমানুয়েল ওরফে চিদারা। ইতোমধ্যে তাকে গ্রেফতার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (নারকোটিক্স)।
এছাড়া চাঞ্চল্যকর এ মামলায় গ্রেফতারকৃত সব আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে ঢাকা বিমানবন্দর ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।
২৪ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রায় ১শ কোটি টাকা মূল্যের সাড়ে ৮ কেজি কোকেন জব্দ করা হয়। এ সময় মাদক বহনের দায়ে আফ্রিকার দেশ মালাউর এক নাগরিক গ্রেফতার হন। পরে টানা অভিযানে আরও একাধিক নাইজেরীয়কে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
সূত্র জানায়, নাইজেরিয়ার নাগরিক ইজাহা ইমানুয়েল ওরফে চিদারা শিক্ষার্থী পরিচয়ের আড়ালে মূলত মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত ছিলেন। পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করে আসছিলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। গ্রেফতার হওয়ার সময় তিনি শেষবর্ষের ছাত্র ছিলেন।
নারকোটিক্স বলছে, চিদারা নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও কোকেন সিন্ডিকেটের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার একাধিক প্রমাণ পাওয়া যায়। বিশেষ করে কোকেন চক্রের মূল হোতা জ্যাকব ফ্রাংক ওরফে ডন ফ্রাংকি এবং পিটার ওরফে অসকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন চিদারা। কোকেন পাচারের সময় তিনি গোপন লেনদেনের জন্য নিজের ক্রিপ্টো কারেন্সি ওয়ালেট থেকে অর্থ ব্যবহার করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক লেনদেন ছাড়াও অন্যতম মাদক মাফিয়া পিটার ওরফে অস্কারের জবানবন্দিতেও চিদারার সম্পৃক্ততা উঠে আসে। ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে অস্কার বলেন, বাংলাদেশে নাইজেরিয়ান কমিউনিটির সভাপতি হিসাবে ফ্রাংকির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। তবে আগে থেকেই তিনি ফ্রাংকির মাদক কানেকশন সম্পর্কে জানতেন। কারণ বিভিন্ন সময় ফ্রাংকি তাকে চিদারার অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে পাঠাতেন। এছাড়া কোকেন নেটওয়ার্কে জড়িত ছিলেন ফ্রাংকির ঘনিষ্ঠ বন্ধু পডোস্কি এবং আত্মীয় ডন উইজলি।
সূত্র জানায়, ২৪ জানুয়ারি কোকেনসহ বিমানবন্দরে গ্রেফতার হওয়ার ১৭ দিন পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন সোকো। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১১ ফেব্রুয়ারি তার জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এতে সোকো বলেন, মাদক মাফিয়া ডন ফ্রাংকির সঙ্গে ফেসবুকে তার পরিচয় হয়। কথাবার্তার একপর্যায়ে ফ্রাংকি তাকে একটি যৌথ ব্যবসার প্রস্তাব দেন। সে অনুযায়ী গত বছরের শেষের দিকে জুতার ফ্যাক্টরি পরিদর্শনের কথা বলে একবার তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। এ সময় বিমান টিকিট থেকে শুরু করে হোটেলে থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সবই জোগাড় করে দেন ফ্রাংকি।
এরপর কাপড় ব্যবসার কথা বলে ২০ জানুয়ারি ফের তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ২৩ জানুয়ারি তিনি নাইজেরিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে রওয়ানা হন। এ সময় তার কাছে একটি স্যুটকেস দেন ফ্রাংকি। ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সে দোহা হয়ে ২৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি ঢাকায় এসে নামেন। ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি হোটেলে তার নামে কক্ষ বুকিং দেওয়া ছিল। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগেই তিনি নারকোটিক্সের হাতে গ্রেফতার হন।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোকেন পাচার চক্রে সাইফুল ইসলাম রনি ও আসাদুজ্জামান আপেল নামের দুই বাংলাদেশির সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তারা ছিলেন মূলত সহযোগীর ভূমিকায়। এদের মধ্যে বারিধারা এলাকার কেয়ারটেকার আসাদুজ্জামান রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভে কোকেন চক্রে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বারিধারা পার্ক রোডে যে বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন সেখানে ভাড়াটিয়া ছিলেন ফ্রাংকি। মূলত ভাড়ার টাকা তুলতে গিয়ে ফ্রাংকির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। কিন্তু পরে বাসা পরিবর্তন করলেও ফ্রাংকির সঙ্গে তার যোগাযোগ থেকে যায়। একপর্যায়ে ফ্রাংকি তাকে কাপড় ব্যবসার পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দিলে আসাদুজ্জামান তা লুফে নেন। দ্রুততম সময়ে তিনি টেড্র লাইসেন্স নিয়ে ব্যাংক হিসাবও খোলেন।
আসাদুজ্জামান তার জবানবন্দিতে বলেন, ফ্রাংকি বাংলাদেশি নাইজেরিয়ান কমিউনিটির সভাপতি ছিলেন। এ কারণে নাইজেরীয় অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। বিশেষ করে নাইজেরিয়ান নাগরিক অস্কার ও পডোস্কি প্রায়ই ফ্রাংকির বাসায় যাতায়াত করতেন। এছাড়া ডন উইজলি নামের এক নিকটাত্মীয় ফ্রাংকির বাসাতেই থাকতেন।
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, বিভিন্ন সময় ফ্রাংকি তাকে লাগেজ কিনে দিতে বলতেন। এভাবে ৫০টিরও বেশি লাগেজ তাকে কিনে দেওয়া হয়। এছাড়া ফ্রাংকির কাছে যারা আসতেন তারাও বিভিন্ন ধরনের লাগেজ নিয়ে আসতেন। তবে ফিরে যাওয়ার সময় তারা ভিন্ন ধরনের লাগেজ নিয়ে যেতেন।
নারকোটিক্স কর্মকর্তারা বলছেন, কোকেনের চালান নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য সাইফুল ইসলাম রনি নামের এক বাংলাদেশিকে ব্যবহার করেন ফ্রাংকি। রনির কাছ থেকে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসার আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করতেন। এছাড়া কোকেন পাচার চক্রের সদস্যদের জন্য হোটেল ভাড়া করে দিতেন রনি।
জবানবন্দিতে রনি বলেন, ফ্রাংকির অনুরোধে তিনি তানজানিয়া, পর্তুগাল, মালয়ী এবং ক্যামেরুনের বেশ কয়েকজনের নামে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করে দেন। একেকটি আমন্ত্রণপত্রের জন্য তাকে ৪০ হাজার টাকা দেওয়া হতো। টাকা জমা হয় তার ব্র্যাক ব্যাংকের সোনারগাঁ জনপথ রোড শাখার অ্যাকাউন্টে।
নারকোটিক্স বলছে, কোকেন চোরাচালান চক্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম নুডলু ইবোকা স্ট্যানলি ওরফে পডোস্কি। তিনি মূলত বাহক হিসাবে ঢাকা থেকে প্রতিবেশী একটি দেশে কোকেনের চালান পৌঁছে দিতেন। এজন্য প্রতি চালানে তাকে ২ হাজার মার্কিন ডলার দেওয়া হতো।
৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পডোস্কি বলেন, ফ্রাংকির বারিধারার বাসায় গেলে তার হাতে কোকেনের চালান তুলে দেওয়া হতো। তিনি ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। এ দেশে তিনি গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।