ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পর্যটন খ্যাত শ্রীমঙ্গল
সিলিকন বালির অবৈধ ব্যবসায় সর্বনাশ
অনুমোদন ছাড়াই শ্যালো মেশিন বসিয়ে রাতদিন বালি উত্তোলন * জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছি-ডিআইজি
নেসারুল হক খোকন
প্রকাশ: ০৭ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সিলিকন বালির অবৈধ ব্যবসায়ীদের তাণ্ডব থামাতে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। এজন্য বালিমহাল ইজারা দিতে ‘পরিবেশ ছাড়পত্র’ বাধ্যতামূলক করা হয়। শ্যালো মেশিন দিয়ে বালি তুলে পরিবেশ ধ্বংস ঠেকাতে এমন নির্দেশনা দেন আদালত। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এরপর আর ইজারা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি অবৈধ বালি ব্যবসায়ীরা। বছরের পর বছর ধরে বালি তুলতে গিয়ে এরা প্রকাশ্যেই ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে সিলেটের বিভিন্ন বালিমহালে। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় দিন দিন এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তনসহ ইতোমধ্যে পরিবেশের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে।
পর্যটনখ্যাত এই এলাকাকে সিলিকন বালির খনি বলা হয়। দেশের আর কোথাও এই বালি পাওয়া যায় না। সিরামিক কারখানাগুলো এই বালির সংমিশ্রণে বিভিন্ন পণ্য বানায়। দিন দিন চাহিদা বাড়ায় বালি তোলার জন্য কেউ নিয়ম-কানুন মানছে না।
শ্রীমঙ্গলসহ ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ মনে করেন, একমাত্র পুলিশ চাইলে যে কোনো সময় এই অবৈধ বালি উত্তোলন বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তারা জেনেশুনে চুপ। শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে যা হয়। বরং বালি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশের যে মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে দুই-চার বছরে পুরো এলাকার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশের সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত যত বড় প্রভাবশালীই হোক ছাড় পাবে না। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি।
তিনি বলেন, পরিবেশ ধ্বংসযজ্ঞ ঠোকাতে স্থানীয় সাধারণ মানুষকে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়তে হবে। সব ধরনের অপরাধ ঠেকাতে সামাজিক সচেতনতা জরুরি। তিনি পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়ার কথা জানান।
বালিমহাল ইজারা দেয় খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)। কথা বলা হয় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (যুগ্মসচিব) মো. আবুল বাশার সিদ্দিক আকনের সঙ্গে। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ইজারা নিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করে বালি তোলার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরিবেশ ছাড়পত্র নিয়ে যে কয়েকটা সিলিকন বালিমহাল ইজারা দেওয়া হয়েছে সেখানে সরেজমিন গিয়ে শ্যালো মেশিন পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে শ্রীমঙ্গলে গিয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে অবৈধ বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। ডিসি ও ইউএনও বলেছেন, তারাও মাঝে মধ্যে অভিযান চালান।
সরেজমিন গিয়ে জানা গেছে, সিলেটের ১৫৬টি স্থান সিলিকন বালির জন্য বিখ্যাত। ২০১৩ সালে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত গেজেটে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে এই বালি তুলতে গিয়ে অবৈধ বালি ব্যবসায়ীদের তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ। ভূনবীর ইউনিয়নের জীবনগঞ্জ বাজারের পশ্চিমে, ঠান্ডা মিয়ার বাড়ির পাশে, জৈতাছড়ার পূর্বদিকের হাওড়ে, প্যারাগনের পাশে, ইসলামপাড়া ও নতুনপাড়ায় অন্তত ১০টি স্থানে শ্যালো মেশিন দেখা গেছে।
এছাড়া মির্জাপুর ইউনিয়নের বৌলাশির গ্রাম থেকেও শ্যালোমেশিনে বালি তুলতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্থানে অন্তত তিনশ ফুট পর্যন্তও গভীর গর্তে পরিণত করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা শ্রীমঙ্গল। ইতোমধ্যে পর্যটনখ্যাত অঞ্চলটির সর্বনাশ করে ফেলা হয়েছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার। ইজারা প্রথা বন্ধ করতে পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্ত দিয়েও বালিখেকোদের টুঁটি চেপে ধরতে পারেনি উচ্চ আদালত।
সিলিকন বালির ১৫৬টি স্থানের মধ্যে ৩৯টিই মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে। এছাড়া একই জেলার কমলগঞ্জে ১০টি, রাজনগরে ১০টি, বড়লেখায় ১২টি, কুলাউড়ায় ৬টি, মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় ৩টি, হবিগঞ্জের মাধবপুরে ৩৪টি, চুনারুঘাটে ২৯টি, বাহুবলে ৯টি এবং সিলেটের সদর উপজেলার আওতায় ২টি এবং ফেঞ্চুগঞ্জে ২টি বালিমহালের তথ্য পাওয়া যায়।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ৩৯টি সিলিকন বালির স্থানে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা উল্লেখ করে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে রিট করে। এরপর ইজারা বন্দোবস্ত স্থগিতাদেশ দেন। পরে ইজারাদারদের পক্ষ থেকে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে ২০১৮ সালে আদালত এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট (পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন) ইআইএ প্রাপ্তি সাপেক্ষে ছড়ার ইজারার অনুমোদন দিতে বলা হয়। এই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১৪২৮ বাংলা সালের বৈশাখ মাস থেকে ১৪২৯ বাংলা সালের ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ২ বছরের জন্য ইজারাসংক্রান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বিদ্যমান বালি ছড়ার ইজারা বন্দোবস্ত পান ইজারাদাররা।
ওই ৩৯টি ছড়ার ইজারাদাররা হাইকোর্ট কর্তৃক পরিবেশ ছাড়পত্রের শর্তারোপের জটিলতায় পড়েন। দরপত্রে অংশগ্রহণের ২৫ ভাগ সিকিউরিটির টাকা জমা দিয়েই বালি উত্তোলনের সুযোগ নেয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও ইজারার সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ না করেই বছরের পর বছর অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করে যাচ্ছে। এতে শুধু বিগত দুই বছরে ভ্যাট, ট্যাক্স ও ইজারা মূল্যসহ এই শ্রীমঙ্গলের বালিমহাল থেকে ইজারাদাররা এক কোটি ৪৭ লাখ ৪ হাজার ৫৬২ টাকা সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে হিসাব করলে এ খাত থেকে প্রায় ২০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্পটেই প্রতি ফুট বালির দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ার কারণে অধিক লাভের আশায় প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বাগান ধ্বংস করে এই বালির ব্যবসায় নেমেছে বালিখেকো সংঘবদ্ধ চক্র।
কৃষক আব্দুর রহিম বলেন, এই দেশের সম্পদ যদি আমরা ধ্বংস করে ফেলি তাহলে তো আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। বড় বড় গর্ত করার কারণে নদীর পাড় ভেঙে যাচ্ছে। সরকার থেকেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। শ্যালো মেশিন দিয়ে বালি তোলার কারণে এ জমিগুলোতে কোনো ফসল করা যাবে না।
কৃষক মো. হাসান মিয়া বলেন, জমি থেকে বালি তোলার অভিযোগ করে কোনো লাভ হয় না। প্রশাসনের লোকজন কোনো উদ্যোগ নেয় না। কেউ কোনো গুরুত্বই দেয় না। যে কারণে বালিখেকোরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোয়াজ্জেম হোসেন সমরু বলেন, দিনরাতে শত শত বালির গাড়ি শ্রীমঙ্গল থেকে বের হয়ে যায়। অথচ এদের কোনো অনুমতি নেই। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে আসছে-যাচ্ছে। শ্রীমঙ্গলের ভুনবীর চৌমুহনায় সিলিকন বালির বড় বড় মজুত কি প্রশাসনের চোখে পড়ছে না? এলাকার সাধারণ মানুষ কী মনে করবে? হঠাৎ একদিন অভিযান চালায়। অবৈধ ব্যবসায়ীরা একটু দূরে সরে যায়। একদিন পর আবার যেই সেই। এতে সহজে অনুমান করা যায় প্রশাসনকে তারা ম্যানেজ করছে।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. ঊর্মি বিনতে সালাম যুগান্তরকে বলেন, অবৈধ বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। কিন্তু স্থানীয় মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিরসনে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট বেগম শাহ সাহেদা আকতার যুগান্তরকে বলেন, অবৈধ বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি। বেলার পক্ষ থেকে দফায় দফায় এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তিনি বলেন, জেলা বালিমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সরকারি ছাড়াও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও নাগরিক সমাজ থেকে প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইজারা চুক্তির শর্ত অনুসারে শর্ত লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিক চুক্তি বাতিল করতে হবে। বালি উত্তোলনের কারণে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে দায়ী ব্যক্তির কাছ থেকে আদায় করতে হবে। বালিমহাল ইজারা দিয়ে রাজস্বের বিপরীতে সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। এই চিত্র নিরূপণ সম্ভব হলে ইজারার মাধ্যমে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা কোনোদিন পূরণ হবে না।
জানতে চাইলে মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মনজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা জানি সিলিকন বালির এসব মহাল লিজ দেওয়া। যদি লিজ না থাকে তাহলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কেউ এ বিষয়ে অবহিত করেনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।