ভুল অ্যানেসথেসিয়ায় ঝরছে প্রাণ
অর্ধলাখ মানুষের জন্য একজন অবেদনবিদ!
অবেদনবিদ স্বল্পতায় সুযোগ নিচ্ছেন অসাধু চিকিৎসকরা * প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ ও সম্মানি কম থাকায় চিকিৎসকদের আগ্রহ কম
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে ছোটবড় প্রায় সব ধরনের অস্ত্রোপচার এবং রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে চিকিৎসকরা রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করে থাকেন। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশে প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে অন্তত পাঁচ থেকে দশজন অ্যানেসথেটিস্ট (অবেদনবিদ) থাকা দরকার। সেখানে বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের জন্য অ্যানেসথেটিস্ট আছেন ৩৫০০ জন। সে হিসাবে প্রায় অর্ধলাখ (৪৮,৫৭১ জন) মানুষের জন্য আছেন মাত্র একজন।
অবেদনবিদ সংকটে অধিকাংশ সময় সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অদক্ষ চিকিৎসক এমনকি প্যারামেডিকস, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টরাও রোগীর দেহে এটি প্রয়োগ করছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সঠিক জ্ঞান এবং সনদ না থাকার পরও সূক্ষ্ম ও জটিল কাজটি করতে গিয়ে ভুল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে সুন্নতে খতনা করানোর সময় লোকাল অ্যানেসথেসিয়ার পরিবর্তে ভুল করে জেনারেল বা ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ায় আহনাফ তাহমিদ নামে এক শিশু মারা যায়। জেএস ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খতনা বা অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের অনুমোদন ছিল না।
এমনকি অভিযুক্ত দুই চিকিৎসকের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধনও নেই। এর একদিন আগে সোমবার ধানমন্ডির ল্যাব এইড হাসপাতালে রাহিদ রেজা (৩১) এবং গত ৭ জানুয়ারি বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফুল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ায় আয়ান আহমেদ নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা জানান, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন একজন অ্যানেসথেটিস্ট। দেশে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতাগুলোতে সার্জন আর অ্যানেসথেটিস্টদের অনুপাত খুবই কম। সদর হাসপাতালগুলোতে সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, নাক-কান-গলাসহ সব বিভাগেই একজন সিনিয়র ও একজন জুনিয়র কনসালট্যান্ট থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যানেসথেটিস্ট থাকেন একজন। কোথাও কোথাও সর্বোচ্চ দুজনের দেখা মেলে। যদিও সার্জন ও অ্যানেসথেটিস্টদের সংখ্যা সমান বা কাছাকাছি হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের হিসাবে, দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলে বিভিন্ন ক্যাটাগরির সাড়ে তিন হাজারের মতো অ্যানেসথেটিস্ট রয়েছেন। সোসাইটির লাইফ মেম্বার আছেন ৮৫০ জনের মতো। এগারোশ’র মতো অ্যানেসথেটিস্ট সরকারি এবং বাকিরা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ও দেশের বাইরে কাজ করছেন। বেশ কিছু সংখ্যক অবসরে গেছেন।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া ও অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ও বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক যুগান্তরকে বলেন, ব্যথামুক্তভাবে অস্ত্রোপচার করার সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করাই হলো অ্যানেসথেসিয়া প্রসিডিউর। মূলত চার পর্যায়ের অ্যানেসথেসিয়া রয়েছে।
এগুলো হচ্ছে জেনারেল (সাধারণ) অ্যানেসথেসিয়া, আঞ্চলিক (রিজিওনাল) অ্যানেসথেসিয়া, উপশম (সেডাকশন) অ্যানেসথেসিয়া ও লোকাল অ্যানেসথেসিয়া। তবে কোন ক্ষেত্রে কী ধরনের অ্যানেসথেসিয়া লাগবে সেটি নির্ভর করে রোগীর অস্ত্রোপচার ও সার্জন যেটা পছন্দ করেন তার ওপর। যে হাসপাতাল-ক্লিনিকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয় সেখানকার অবকাঠামো, পরিবেশ, যন্ত্রপাতি ও ওষুধের ব্যবহার ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেটিও দেখতে হবে। প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা অনুমোদন ও সেবাদাতা চিকিৎসকের নিবন্ধন আছে কি না তা জানতে হবে।
ডা. দেবব্রত বণিক আরও বলেন, সঠিকভাবে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগের পূর্বে রোগীকে পর্যালোচনা করতে হয়। যেমন-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া, অস্ত্রোপচারের পূর্বে রোগী কোনো খাবার খেয়েছেন কি না জানা, জটিল রোগব্যাধির ইতিহাস থাকলে জানা। অস্ত্রোপচার কক্ষে নেওয়ার পর সঠিক ও পরিমাণ মতো ওষুধ ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে কোনো ওষুধ দিলে রোগীর শরীর তা গ্রহণ করতে পারবে যাচাই করা।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেটির চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা থাকা। এভাবে ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া শেষ করে রোগীর প্রকৃত অবস্থা স্বজনদের জানানো দরকার।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, যে অস্ত্রোপচার এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে তাতে জেনারেল বা ফুল অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমতো ওষুধ প্রয়োগ করে অস্ত্রোপচারের সময়সীমা বৃদ্ধি করা যায়। জেনারেল অ্যানেসথেসিয়ার মাধ্যমে রোগীকে পরিপূর্ণভাবে অচেতন করা হয়। এতে রোগী ঘুমিয়ে থাকে।
রিজিওনাল অ্যানেসথেসিয়ায় কোমরের নিচে কোনো অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অংশ অবশ করতে দেওয়া হয়। আর লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয় কোনো সেলাই, ফোড়া কাটা, এনজিওগ্রামের কোনো প্রসিডিউর করার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এক-দেড় ইঞ্চির মতো জায়গা অবশ করা হয়। আর সেডাকশন অ্যানেসথেসিয়াকে ওভাবে অ্যানেসথেসিয়া ধরা হয় না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এবিএম মাকসুদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, অ্যানেসথেসিয়া নির্বাচন একটি জটিল সিদ্ধান্ত। কোন রোগীকে কী অবস্থায় কোন অ্যানেসথেসিয়া দিতে হবে রোগীর সক্ষমতা ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সার্জন ও অ্যানেসথেটিস্ট তা নির্ধারণ করেন। অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে অ্যানেসথেটিস্ট গুরুত্বপূর্ণ টিম মেম্বার হিসাবে থাকে।
আইসিইউ ম্যানেজমেন্টেও কাজ করেন অ্যানেসথেটিস্টরা। দেশে অ্যানেসথেসিয়া বিষয়ে ডিপ্লোমা, এমডি, এফসিপিএস ও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ করা চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে যে পরিমাণ দক্ষ চিকিৎসক প্রয়োজন তার তুলনায় সংখ্যাটা অপ্রতুল।
চিকিৎসকরা বলেন, দেশে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে অ্যানেসথেটিস্টদের যে পরিশ্রম, সে অনুযায়ী সম্মানি নেই। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা যখন দেখেন মেডিসিন বা সার্জারি বা অন্য যেকোনো সেক্টরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে এই সেক্টরের চেয়ে সম্মানিটা বেশি, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা এ সেক্টরের প্রতি আগ্রহ হারায়।
অ্যানেসথেটিস্টদের স্বল্পতার সুযোগ নিয়েই একশ্রেণির অসাধু চিকিৎসক তথ্য গোপন করে রোগীদের অ্যানেসথেসিয়া দিচ্ছে। রোগীর জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। এই দায় পড়ছে সব চিকিৎসকের ওপর।