কামরাঙ্গীরচরে বাণিজ্যিক অঞ্চল তৈরির উদ্যোগ
ডিএসসিসির চাপে বন্ধ ভবন নির্মাণ অনুমোদন
ঢাকার প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক বিশ্লেষণ না করেই ভবন নির্মাণ বন্ধ করা ও ৫০ তলা ভবন নির্মাণের ঘোষণা অবাস্তব চিন্তা : শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান, সাধারণ সম্পাদক, বিআইপি
মতিন আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ডিএসসিসির চাপে বন্ধ ভবন নির্মাণ অনুমোদন
মতিঝিলের আদলে কামরাঙ্গীরচরে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সিবিডি) গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এজন্য ওই এলাকায় নতুন ভবন নির্মাণের অনুমোদন বন্ধ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ঢাকার প্রেক্ষাপটে সার্বিক উপযোগিতা বিশ্লেষণ না করে এমন উদ্যোগকে অবাস্তব চিন্তা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের মতে, সিটি করপোরেশন প্রায় ৩ বছর আগে সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে। যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়েছিল, তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে কামরাঙ্গীরচর এলাকার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছে। ডিএসসিসি ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেছে। কবে তা শেষ হবে তাও অজানা। প্রথম উদ্যোগের মতো এটিও ব্যর্থ হতে পারে। এছাড়া সার্বিক বিশ্লেষণে ওই এলাকা কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল নির্মাণের উপযোগী কিনা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমতাবস্থায় ওই এলাকার নির্মাণ অনুমোদন বন্ধের সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি। এতে কামরাঙ্গীরচরে অবৈধ ভবন নির্মাণ বাড়বে। পাশাপাশি জমির দাম কমে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, কামরাঙ্গীরচর থানায় ডিএসসিসির ৩টি ওয়ার্ড; সেগুলো হলো-৫৫, ৫৬ ও ৫৭। সেখানে প্রায় ২২ হাজার ভবন গড়ে উঠেছে। বসবাস প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। মিশ্র ভূমি ব্যবহারের ওই এলাকায় শত শত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে উঠেছে। সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ডিএসসিসির তড়িঘড়ি এই উদ্যোগ ওই এলাকার সার্বিক কার্যক্রমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা তাদের।
তারা আরও জানায়, কামরাঙ্গীরচরের তিনটি ওয়ার্ডে জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫০০ একর। ডিএসসিসি সেখানে ৫০ তলা বিশিষ্ট কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করবে। ইতোমধ্যে ওই কনভেনশন সেন্টারের নাম ঠিক করা হয়েছে শেখ হাসিনা কনভেনশন সেন্টার। পাশাপাশি ১৪০ ফুট প্রশস্ত সড়ক তৈরি হবে; ওই সড়কের নাম দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম সরণি। আর আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেলের ওপর বহুলেন বিশিষ্ট একটি সেতু নির্মিত হবে। ওই সেতুর নাম ঠিক করা হয়েছে মেয়র তাপস সেতু। এই নগর সংস্থায় ওই এলাকায় তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী কি কি করতে চায়, সবকিছু নির্ধারণ করে ফেলেছে। তবে সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয়সংখ্যক সমীক্ষা না করে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ওই উদ্যোগ নিয়ে শঙ্কিত তারা।
ডিএসসিসি ও রাজউক সূত্রে জানা যায়, সেপ্টেম্বরে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান রাজউক চেয়ারম্যানকে একটি পত্র দেন। সেখানে জানান, কামরাঙ্গীরচর থানার আওতাধীন সিটি করপোরেশনের ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে পরিকল্পিতভাবে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল (সিবিডি) তৈরির পরিকল্পনা করছে ডিএসসিসি। ওই এলাকায় সিবিডি গড়ে তোলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ভবনের নির্মাণ অনুমোদন বন্ধ না রাখলে সিবিডি বাস্তবায়নে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এর আগে একই বিষয়ে অবহিত করে ২০২১ সালের অক্টোবরে ডিএসসিসি রাজউক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে একই বিষয়ে অবহিত করেছিল। দুটি চিঠি দিয়ে একই অনুরোধ করায় গত মাসে রাজউকের সংশ্লিষ্টরা কামরাঙ্গীরচরে নতুন করে আর কোনো ভবন নির্মাণ অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা যায়, কামরাঙ্গীরচরের সিংহভাগ জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন।
এজন্য ওই এলাকায় ডিএসসিসির সিবিডি বাস্তবায়ন করতে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। বিষয়টি ওই এলাকার বাসিন্দারা জানতে পারায় তাদের মধ্যে আতঙ্ক ও হতাশা বিরাজ করছে। তবে সিটি করপোরেশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিবিডির উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে ওই এলাকার মানুষও লাভবান হবে। কারও জমি অধিগ্রহণ করা হলে তাদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা যুগান্তরকে বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে রাজউক কামরাঙ্গীরচরে নতুন করে আর কোনো ভবনের অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেননা, সিটি করপোরেশন সেখানে একটি পরিকল্পিত বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এই মুহূর্তে ওই এলাকায় নতুন স্থাপনা নির্মিত হলে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়নে জটিলতার সৃষ্টি হবে বলে ডিএসসিসি রাজউককে জানিয়েছে। বারবার তারা ওই এলাকায় ভবন নির্মাণ অনুমোদন বন্ধ রাখতে বলেছে। এজন্য এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, রাজউক কামরাঙ্গীরচরে নতুন করে আর কোনো ভবনের অনুমোদন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কেউ রাজউকে আবেদন করলে, তাদের সিটি করপোরেশনের অনুমোদন নিতে বলা হবে। অর্থাৎ, ওই এলাকার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহাম্মদ মেহেদী আহসান যুগান্তরকে বলেন, সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক (সিবিডি) বা কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল কেন তৈরি হয়? এটা তৈরির পেছনে কিছু কারণ থাকে। সিবিডি তৈরি হয় যেখানে বিভিন্ন ধরনের অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থাকে সেখানে। মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, শাপলা চত্বর, সচিবালয় ও আশপাশের এলাকা ঢাকার সিবিডি। তবে ঢাকায় এখন কয়েকটি সিবিডি গড়ে উঠেছে। তারমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য; গুলশান, কাওরান বাজার, ধানমন্ডি এলাকা। নতুন করে বাণিজ্যিক অঞ্চল করতে চাইলে তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হতে হবে। কেন করতে চাই, কিভাবে করতে চাই, তা ভালো করে বুঝতে হবে।
তিনি বলেন, ৫০ তলা ভবন, ১৪০ ফুট সড়ক এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু করলে তা সুফল বয়ে আনবে না। গবেষণা, পরিকল্পনা বা ঢাকার প্রেক্ষাপটে সামগ্রিক বিশ্লেষণের ফলাফলের ভিত্তিতে কি করা হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। সেখানে কি করতে চায়, কাদের আনতে চায় তা ঠিক করে কাজ করতে হবে।
তিনি জানান, কামরাঙ্গীরচরে পরিকল্পিত উপায়ে সুন্দর নগরায়ণ হতে পারে। সেখানে কি করলে ভালো হবে, ঢাকার সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও ভৌগোলিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। এসব দিক বিবেচনায় না রেখে হঠাৎ করে নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ অবাস্তব চিন্তা বলে মনে করেন তিনি ।
ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কামরাঙ্গীরচরে সিটি করপোরেশন মতিঝিলের আদলে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যিক অঞ্চল গড়ে তুলতে চায়। সেখানে ৫০ তলা বিশিষ্ট কনভেনশন সেন্টার, ১৪০ ফুট সড়ক ও পরিকল্পিতভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম গড়ে তোলা হবে। সেলক্ষ্যে আমরা সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও আলোচনা করছি। পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের নগর পরিকল্পনাবিদরা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন, কামরাঙ্গীরচরে সিবিডি করতে হলে জমি অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন হবে। এখন সেখানে কেউ ভবন নির্মাণ করলে তারা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে আবার অধিগ্রহণ ব্যয়ও বাড়বে। এজন্য রাজউককে বারবার অনুরোধ করে নির্মাণ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি রাজউক ওই এলাকার নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপাতত এখন কামরাঙ্গীরচর এলাকায় কেউ নতুন করে ভবন নির্মাণ অনুমোদন পাবে না।