Logo
Logo
×

শেষ পাতা

বেসরকারি চিকিৎসা খাতে নৈরাজ্য

সাধারণ অস্ত্রোপচার ব্যয়ও বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সাধারণ অস্ত্রোপচার ব্যয়ও বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ

বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফিসহ সব ধরনের চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে ওষুধের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানিতে খরচ বাড়ার অজুহাতে দুই বছর ধরে দফায় দফায় ফি বাড়ানো হয়। পাশাপাশি রোগীদের সাধারণ অস্ত্রোপচারের খরচ বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। চিকিৎসাসেবা মূল্য নির্ধারণে জাতীয় মানদণ্ড বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাইডলাইন না থাকা ও নজরদারির অভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যাওয়া রোগীদের ওপর ব্যয়ের অস্বাভাবিক খরচ চাপছে।

এদিকে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবার পেছনে বাড়তি খরচ ছাড়াও সেবাকেন্দ্রে আসা-যাওয়ায় পরিবহণ ভাড়া বাবদও রোগীদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। প্রতিবার ফলোআপের জন্য চিকিৎসক ফি, নতুন নতুন পরীক্ষা, বাড়তি দামে ওষুধ ক্রয় এবং হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের বেলায় অ্যাটেনডেন্টের থাকা-খাওয়ার খরচও বেড়েছে। ফলে অনেকে পরিপূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই মাঝপথে চিকিৎসা নেওয়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সাধারণত রোগীরা প্রতিনিয়ত যেসব ছোটখাটো অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন তার মধ্যে রয়েছে- সিজার, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, হার্নিয়া, চোখের ছানি অপারেশন, গলব্লাডারের পাথর অপসারণ, প্রস্টেটগ্রন্থি অপসারণ, জরায়ুমুখের টিউমার, কিডনি ডায়ালাইসিসের জন্য ফিস্টুলাসহ আরও নানাবিধ শারীরিক সমস্যা। এসব অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে হাসপাতালভেদে ২ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১৫ হাজার ১৪৯টি বৈধ হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংক আছে। এর মধ্যে ৫ হাজার বেসরকারি হাসপাতাল ও ১০ হাজার ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমোদন নিয়ে চলছে। ৭০০ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও সব শর্ত পূরণ না করায় লাইসেন্স পায়নি। বর্তমানে ১ হাজার ২৮৫টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবৈধভাবে চলছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার জন্য অধিদপ্তর উদ্যোগ নিয়েছে।

গত দুই বছরে ডলারের দাম ৮৪ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত গড়ায়। মূল্য বৃদ্ধির শুরু থেকেই গত দুই বছরে বৈধ-অবৈধ প্রায় সব বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রই রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে শুরু করে সব খাতে অস্বাভাবিক অর্থ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রোগ পরীক্ষার মূল্য তালিকা টানানো ও শয্যা ভাড়া ছাড়া কোন খাতে কত টাকা নেওয়া হচ্ছে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে না।

এদিকে ডলার সংকটে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে গত দুই বছরে অত্যাবশ্যকীয় ৯০ শতাংশের বেশি ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। ২০২২ সালের ২০ জুলাইয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপন দিয়ে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এর পাঁচ মাসের মধ্যে ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয়বার প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টি ওষুধের দাম বাড়ায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে একদিকে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন, অন্যদিকে জীবন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম শুধু বাড়ছে। নতুন করে দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে ওষুধ শিল্প সমিতি।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে, চিকিৎসাপ্রার্থীদের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ অর্থই ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। বাকিটা রোগ নির্ণয় বা বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসক দেখানো, হাসপাতালে ভর্তি এবং অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা নেওয়ার পেছনে ব্যয় হচ্ছে।

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৮, ২০১৯ ও ২০২০ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ ছিল যথাক্রমে ২৮, ২৬ ও ২৩ শতাংশ; অর্থাৎ তিন বছর ধরে পর্যায়ক্রমে তা কমেছে। বিপরীতে ওই বছরগুলোতে ব্যক্তির নিজ ব্যয় ছিল যথাক্রমে ৬৪, ৬৬ ও ৬৯ শতাংশ, অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে তা বেড়েছে। এভাবে চার বছর ধরে চিকিৎসা খরচ বাড়লেও সরকার তাতে লাগাম টানতে পারছে না।

সৌরভ নামে একজন গণমাধ্যমকর্মী যুগান্তরকে জানান, বছরতিনেক আগে মগবাজারের মনোয়ারা জেনারেল হাসপাতালে তার স্ত্রী সিজারিয়ান পদ্ধতিতে প্রথম সন্তান প্রসব করেন। ওই সময় ব্যয় হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা। চলতি মাসে একই হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের জন্য যোগাযোগ করা হলে কর্তৃপক্ষ ৮০ হাজার টাকা দাবি করে। আগেরবার সিজারের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। পরে স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী বেসরকারি কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে সিজারের জন্য ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়।

জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও ইউরোলজি হাসপাতালে নিয়মিত ডায়ালাইসিস নেন মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দা পাপ্পু (৪৫) ও মিরপুরের বাসিন্দা মো. খোকন (৩৭)। বৃহস্পতিবার ইনস্টিটিউটটিতে এই দুই রোগীর স্বজনদের সঙ্গেই এই প্রতিবেদকের কথা হয়। খোকনের স্ত্রী জানান, দুই বছর আগে ১৩ হাজার টাকায় কিডনি ইনস্টিটিউটের বিপরীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্বামীর হাতে ফিস্টুলা অস্ত্রোপচার করান। দুই মাস আগে ওই হাসপাতালে একই অস্ত্রোপচার করান কিডনি রোগী পাপ্পু। তার খরচ হয় ১৬ হাজার টাকা।

পাঁচ দিন আগে ১০ শতাংশ চিকিৎসা ব্যয় বাড়িয়েছে শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়কে খরচ বৃদ্ধির তথ্য জানায়নি প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ওই হাসপাতালে সাধারণ সিজারের অস্ত্রোপচারে এক লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা, সুন্নাতে খতনার জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা খরচ পড়ে।

খরচ বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মনোয়ার সাদিক যুগান্তরকে বলেন, ওষুধ থেকে শুরু করে রোগীদের সেবাদানে ব্যবহৃত সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বেড়েছে। আগে সরবরাহকারীরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ লাভে চিকিৎসা পণ্য বিক্রি করলেও বর্তমানে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। বাধ্য হয়েই সেবামূল্য ১০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে বিছানা ভাড়া, অক্সিজেন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূল্য বাড়ানো হয়নি। মূলত ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে টিস্যু পেপার থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বাড়ছে।

বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল-ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, দেশে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক এবং ৭ হাজারের মতো ডায়াগনসিস সেন্টার রয়েছে। সবখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও শয্যা ভাড়ার মূল্য তালিকা টানানোর নির্দেশনা আছে। সেবার মানভেদে খরচ, কনসালটেন্ট ফি বা অস্ত্রোপচার খরচ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশনের কিছু করার নেই। রোগীরা সব দেখেই হাসপাতালে যাচ্ছে। তবে ব্যয়ভার কমাতে হলে স্বাস্থ্যবিমা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন দরকার। হাসপাতাল ক্যাটাগরি নিয়েও কাজ চলছে। চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণ করতে হলে চিকিৎসক সমাজ, মন্ত্রণালয়, বিএমএ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মাদ খুরশীদ আলম যুগান্তরকে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা মূল্য বাড়ানোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আইনকানুন নেই। আগে আলোচিত হাসপাতাল ক্যাটাগরির বিষয়ে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে চিকিৎসাসেবার বাস্তবতা সবার জানা। বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ক্যাটাগরি চালুর বিষয়ে আমাকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে হাসপাতাল মালিকরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসতে চাইলে আমরা প্রস্তুত আছি। সার্বিক মূল্য নির্ধারণে অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলব। সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। না হলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম