বাপেক্সে নিয়োগে ফের অনিয়মের অভিযোগ
বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিয়োগ নিয়ে ফের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বাপেক্সের (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড) বিরুদ্ধে। বিভিন্ন পদে ৫৪ জনের নিয়োগ ও চাকরি স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নানা ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা, নকল অভিজ্ঞতা সনদধারীদের প্রধান্য, জেলা কোটার অজুহাতসহ নানা কারণে যোগ্যদের বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। অনিয়মে বাড়তি সুবিধা আদায়ে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বাপেক্সের প্রভাবশালীদের পোষ্য ও আত্মীয়স্বজনকে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব যুগান্তরকে জানান, এগুলো পুরোনো অভিযোগ, তার আমলে হয়নি। তার যোগদানের পর যদি কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠে, তাহলে সেগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, নিয়োগ এখনো হয়নি। নিয়োগ হওয়ার আগে দুর্নীতি হয়েছে, এটা বলা যাবে না। কোনো ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে যোগ করেন তিনি।
এবার ৫৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন প্রতিষ্ঠানের অস্থায়ী কর্মচারীরা। জ্বালানি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, অস্থায়ী জনবল থেকে অভিজ্ঞদের অগ্রধিকার দিয়ে তারপর বাকিদের নিয়োগ দেওয়া হোক। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এই নির্দেশনা মানছে না বাপেক্সের নিয়োগ শাখা।
এর আগে ৫ বছরে ৪ দফায় নিয়োগ নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। পদ স্থায়ীকরণের বিষয়ে মন্ত্রণালয়, উচ্চ আদালত ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা পেট্রোবাংলার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগে অবশ্যই রাজস্বভুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা দক্ষ ও অভিজ্ঞ, তাদের অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়। কিন্তু প্রতিবারই এ নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখান সংশ্লিষ্টরা। উলটো নিয়োগ পাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন আর অদক্ষরা। কারণ, নতুন নিয়োগ বা স্থায়ীকরণ মানেই নানা ধরনের অনৈতিক বিষয়ের যোগসাজশ। এ ধরনের ঘটনার পর প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত রিপোর্টও জমা পড়ে। কিন্তু কিছুদিন পর গায়েব হয়ে যায় তদন্ত রিপোর্ট।
জানা যায়, ৫ বছরে শুধু নিয়োগ কেলেঙ্কারি নিয়ে বাপেক্সে ৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মামলাও হয়েছে একাধিক। এখনো আদালত অবমাননার একটি মামলা চলমান। ৪টি তদন্ত কমিটির রিপোর্টে নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে সব তদন্ত রিপোর্টে। একটি রিপোর্টে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি, বিভাগীয় মামলা, অডিট করানো, এমনকি নিয়োগকৃতরা যত বেতনভাতা পেয়েছেন, সব টাকা ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্টও শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। যারা নিয়োগ দিয়েছেন এবং যারা নিয়োগ পেয়েছেন-এমন অভিযুক্ত কারও বিরুদ্ধেই এ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ২০০৫ সালে ১৪২ জন, ২০১৮ সালে ৬ জন, ২০১৯ সালে ৮৫ জন এবং ২০২২ সালে ৩৩ জন কর্মীকে নিয়োগ প্রদান ও স্থায়ীকরণেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। প্রতিটি অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলাও গড়িয়েছে। অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বর্তমানে আদালত অবমাননার মামলাও চলমান। সম্প্রতি ৫৪ জনের নিয়োগেও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী অস্থায়ী কর্মচারীদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়ার বিষয়টিও আমলে নেওয়া হচ্ছে না। উলটো অস্থায়ী কর্মীদের মধ্য থেকে যারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের অনেককে জেলা কোটা না থাকার অজুহাত দেখিয়ে বাদ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। যদিও এবারের নিয়োগে জেলা কোটার বিষয়টি বাদ রাখা হয়েছে। এছাড়া অনেকে অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট দিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও দেখা গেছে সনদগুলো অধিকাংশ ভুয়া ও জাল। খোদ বাপেক্সের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, বাপেক্স বাংলাদেশের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন কোম্পানি। এ ধরনের কারিগরি কাজ আর কোথাও নেই। যার ফলে অন্য যারা অভিজ্ঞতার সনদ দিচ্ছেন, সেগুলো কতটা সত্য, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
এছাড়া শিক্ষা সনদ ছাড়াই বিপুলসংখ্যক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গত কয়েক বছরে। এসব নিয়োগের বিচার চেয়ে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১৩ জনকে নোটিশ (নোটিশ ডিমান্ডিং জাস্টিস) পাঠিয়েছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এবিএম সিদ্দিকুর রহমান খান। ওই নোটিশও আমলে নেয়নি বাপেক্স। এরপর রিট দায়ের করা হয়।
নোটিশ ফর ডিমান্ডিং জাস্টিস থেকে জানা যায়, এক কর্মচারী জাল শিক্ষা সনদ জমা দিলেও তার চাকরি স্থায়ী করা হয়। কোম্পানির সাংগঠনিক কাঠামোয় লিফট টেকনিশিয়ান ফোরম্যান, অস্থায়ী লিফট অপারেটর, অস্থায়ী সিসিটিভি অপারেটর, পাম্প অপারেটর, সিসিটিভি অপারেটর, সিসিটিভি অপারেটর এবং সোলার মেনটেইন্যান্স পদ নেই। এরপরও বেশ কয়েকজনকে অন্য পদে স্থায়ী করা হয়।
জানা যায়, এভাবে অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া কর্মীদের বেতনভাতা বন্ধ করাসহ বিভিন্ন সুপারিশ করা হলেও তারা বহাল তবিয়তে আছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এবার বিভিন্ন স্থায়ী পদের বিপরীতে ৫৪ জনকে নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি চূড়ান্তভাবে কোনো অনিয়ম হয়, তাহলে ভুক্তভোগীরা ফের আদালতে মামলা করবেন। বিষয়টি ইতোমধ্যে তারা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। ভুক্তভোগীদের দাবি, মন্ত্রণালয় ও আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অস্থায়ী কর্মীদের মধ্যে যারা মেধাবী ও যোগ্য, তাদের আগে নিয়োগ দিতে হবে।