Logo
Logo
×

শেষ পাতা

জামানত হারিয়েছেন ইসলামি দলগুলোর অধিকাংশ প্রার্থী

তানজিল আমির

তানজিল আমির

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জামানত হারিয়েছেন ইসলামি দলগুলোর অধিকাংশ প্রার্থী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭টি ইসলামি দলের প্রার্থী ছিলেন ২৭৬ জন। এদের মধ্যে একজনও জয়লাভ করেননি। এমনকি দ্বিতীয়-তৃতীয় অবস্থানে তথা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই আসতে পারেননি। বরং জামানত হারিয়েছেন অধিকাংশ প্রার্থী। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার অভাব ও রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতা না থাকায় ভোটের মাঠে ইসলামি দলগুলো সুবিধা করতে পারছে না। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি ও জনসম্পৃক্ত ইস্যুগুলোতে সরব না হলে সামনে তাদের ভোট আরও কমতে পারে।

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামি দল ১১টি। এর মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আপত্তি ছিল তাদের। এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৭টি ইসলামি দল হলো-ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জাকের পার্টি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি।

এর মধ্যে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী ছিলেন ৩৯, ইসলামী ঐক্যজোটের ৪২, জাকের পার্টির ২১, ইসলামী ফ্রন্টের ৩৭, খেলাফত আন্দোলনের ১১, তরিকত ফেডারেশনের ৩৮ ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯ জন। এছাড়া বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্রভাবে কয়েকজন আলেম এবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে শুধু সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট) আসনে নৌকাকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আঞ্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি ও ফুলতলীর পির মাওলানা মোহাম্মদ হুছাম উদ্দিন চৌধুরী।

চট্টগ্রাম জেলাতেই তরিকতপন্থি চারটি ইসলামিক দলের চেয়ারম্যান-মহাসচিব জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচনে নতুন নিবন্ধিত বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) বাদেও তরিকত ফেডারেশন, ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান-মহাসচিবরা নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামানত হারিয়েছেন।

বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) চেয়ারম্যান সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভাণ্ডারী এবং তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান মাওলানা এমএ মতিন চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে, দলটির মহাসচিব অধ্যক্ষ স উ ম আবদুস সামাদ চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) আসনে, এবং ইসলামিফ ফ্রন্ট বাংলাদেশের মহাসচিব আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইর চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী-পাহাড়তলী-হালিশহর) ও চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-ডবলমুরিং) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

তবে নির্বাচনের দুই দিন আগে সংবাদ সম্মেলন করে সরে দাঁড়ান তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। তবে ব্যালটে তার প্রতীক থেকে যাওয়ায় চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) তিনি ফুলের মালা প্রতীকে ২৩১ ভোট পেয়েছেন। ওই আসনে ভোট পড়েছে এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৬৫টি।

চট্টগ্রাম-১০ (খুলশী-পাহাড়তলী-হালিশহর) আসনে ভোটার চার লাখ ৮৫ হাজার ৮০১ জন। এ আসনে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের প্রার্থী দলটির মহাসচিব আবুল বাশার মুহাম্মদ জয়নুল আবেদীন জুবাইর চেয়ার প্রতীকে পেয়েছেন মাত্র ৫৬৫ ভোট। এ আসনে ভোট পড়েছে এক লাখ পাঁচ হাজার ১৩৪টি। চট্টগ্রাম-১১ (পতেঙ্গা-বন্দর) আসনেও তিনি দুই হাজার ১৫১ ভোট পেয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এমএ মতিন মোমবাতি প্রতীকে আট হাজার ২৯৮ ভোট পেয়েছেন। হিসাব অনুযায়ী জামানত ফিরে পেতে এ আসনে তাকে ২১ হাজারের মতো ভোট পেতে হতো।

চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ-সাতকানিয়া আংশিক) আসনে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মহাসচিব সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আবদুস সামাদ মোমবাতি প্রতীকে পেয়েছেন পাঁচ হাজার ২৩১ ভোট। জামানত ফেরত পেতে দরকার ছিল ১৪ হাজার ৬৫৮ ভোট।

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দুটি দল খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে বটগাছ প্রতীকে পেয়েছেন ২ হাজার ৬৩৫ ভোট। দলটির নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে ৪৭৩ ভোট পেয়েছেন। সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মহিউদ্দিন কুমিল্লা-২ আসনে পেয়েছেন ২২২ ভোট।

ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত আমিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে মিনার প্রতীকে ৯৯৪ ভোট পেয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিব আলতাফ হোসাইন কুমিল্লা-২ আসনে ৯৪৪ ভোট পেয়েছেন। আরেক যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ তৈয়্যেব হোসাইন ময়মনসিংহ-২ আসনে পেয়েছেন ১ হাজার ৭৫৩ ভোট।

ইসলামিক দলগুলোর বাইরে বিভিন্ন দল ও স্বতন্ত্রভাবে কয়েকজন আলেম এবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে শুধু সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট) আসনে নৌকাকে হারিয়ে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আঞ্জুমানে আল ইসলাহ’র সভাপতি ও ফুলতলীর পির মাওলানা মোহাম্মদ হুছাম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি পেয়েছেন ৪৭ হাজার ১৫৩ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার মাসুক উদ্দিন আহমদ পেয়েছেন ৩২ হাজার ৯৭৩ ভোট।

৫ ডিসেম্বর হুছাম উদ্দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানিয়েছে, নৌকার প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও হুছাম উদ্দিনকে জিতিয়ে আনতে সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের তৎপরতা ছিল।

বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির মহাসচিব মাওলানা আতাউর রহমান আতিকী বাংলাদেশ কংগ্রেস থেকে বাগেরহাট-১ আসনে ডাব প্রতীকে ১১৭৫ ভোট পেয়েছেন।

ইসলামী দলগুলোর ভোট বিপর্যয়ের ব্যাপারে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা মুভ ফাউন্ডেশনের প্রধান সাইফুল হক বলেন, আমাদের সমাজ আলেম-ওলামা বা ইসলামী দলের নেতাদের ধর্মীয় কারণে ভক্তি করে থাকেন। তাই তাদের সংশ্লিষ্ট কাজে শ্রদ্ধা, সম্মান ও গুরুত্ব দিলেও সামাজিক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদেরকে ততটা উপযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। সেইসঙ্গে ইসলামি দলগুলোর রাজনৈতিক আদর্শ সুনির্দিষ্ট নয়। লক্ষ্য উদ্দেশ্যবিহীন এবং কর্মপরিকল্পনা অগোছাল। আবার যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা দিতে চান, ভোটের মাঠে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তেমন নেই।

তিনি বলেন, নিজ মাদ্রাসার ছাত্রকেন্দ্রিক (যাদের অধিকাংশই ভোটার নয়) জনপ্রিয়তা ও জনসমাগমকে রাজনীতির মাঠের জনপ্রিয়তা মনে করা এক ধরনের বোকামি।

মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম কাউন্সিল সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির যুগান্তরকে বলেন, ইসলামি দলগুলোর যে প্রার্থীরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারা কেউই বিজয়ী হওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করেননি। তেমনি নির্বাচনকালীন বিজয়ী হওয়ার মতো কৌশল প্রয়োগ করতে সক্ষম হননি। বলতে গেলে তারা লোক দেখানো নির্বাচন করেছেন।

ভোট বিপর্যয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দেশে নির্বাচনের যে পরিস্থিতি তাতে সৎ আদর্শবান মানুষের জিতে আসা অনেকটা কঠিন। এখন নির্বাচনে পেশিশক্তি ও কালোটাকার ছড়াছড়ি হয়। যে দেশে কালোটাকার মাধ্যমে ভোট কেনা যায় সেখানে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সরকারিভাবে ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও এটির কোনো বাস্তবায়ন নেই। অনেকে শত কোটি টাকাও খরচ করেন। তাহলে নির্বাচনের পরিবেশ ভালো হবে কিভাবে?

ইসলামী দলগুলোর প্রার্থীরা শুধু অংশগ্রহণের জন্য ভোটে দাঁড়িয়েছেন কি না এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইসলামী দলগুলো ‘দাওয়াতি রাজনীতি’ করে। সে হিসাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়াটাও আমাদের দাওয়াতের অংশ। সবাই যে শুধু অংশগ্রহণ বা সুবিধার জন্য দাঁড়িয়েছে এমন নয়।

 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম