৮৭ লাখ কোটি টাকার অডিট আপত্তি
১৩ বছরে আদায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা
দ্রুত নিষ্পত্তির আইন নেই, এটি করতে হবে-সাবেক সিএজি মাসুদ আহমেদ * অনিয়মের রাজস্ব ও আপত্তির অর্থ ঠিকমতো আদায় হবে না-মইনুল ইসলাম
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সর্বশেষ ঘটনায় বেসিক ব্যাংকের ৩৯৮ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে। এর আগে একই ব্যাংকের ঋণ অনিয়ম ধরা পড়ে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। অপরদিকে জমি অধিগ্রহণের পাওনা ঘিরে ৪ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার অনিয়ম শনাক্ত হয় ২৪টি ডিসি কার্যালয়ে। ভিন্ন ঘটনায় কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য সরঞ্জাম কেনাকাটাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, জ্বালানি তেল ক্রয়, ব্যাংক ও রাজস্ব খাত ঘিরে অনিয়ম ধরা পড়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকারি অর্থব্যয়ে আর্থিক অনিয়ম ও আপত্তির অঙ্ক ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত ৮৭ লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে অনিয়ম। এটি জাতীয় বাজেটের তুলনায় ১৩ গুণ বেশি। চলতি বাজেটের আকার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি অনিয়মসংক্রান্ত সরকারি অর্থের বিপরীতে গেল অর্থবছর (২০২২-২৩) আদায় করেছে ২৬ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। বিগত ১২ বছরে (২০১০-২০২২) উদ্ধার হয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এসব অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সরকারি অর্থব্যয় ঘিরে যে হারে অনিয়ম বাড়ছে, বিপরীতে আদায় খুবই কম। অনিয়মের অর্থ আদায় পুরোপুরি সম্ভব হলে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হতো। এতে স্বল্প মেয়াদে বর্তমান সরকারের চলমান আর্থিক সংকট লাঘবে কার্যকর ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে বাজেট ঘাটতি মেটাতেও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই অর্থ আদায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে জানান, অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম হলে যে আপত্তি দেওয়া হয়, সেই আপত্তির অর্থ ঠিকমতো কখনোই আদায় হবে না। কারণ, সর্বত্র অনিয়মের রাজত্ব গেড়ে বসেছে। ওরা এটি কখনোই সমাধান করতে পারবে না। কারণ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছা না থাকলে এগুলো বাড়তেই থাকবে।
অর্থ উদ্ধার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অডিট আপত্তি মানেই পুরোটা দুর্নীতি বা অনিয়ম নয়। অর্থব্যয়ের ত্রুটিবিচ্যুতির একটি প্রাক্কলন করে সিএজি অফিস দায়িত্ব সারছে। পাশাপাশি গত বছরের আদায়ের চিত্রও তুলনামূলক ভালো। তবে আপত্তি ও আদায়ের মধ্যে যে ফারাক, এটি বিশাল। এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার দায়িত্ব সিএজি অফিসের। পাশাপাশি এ আপত্তির বিষয়ে অনুসন্ধান করে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহি যেন নিশ্চিত করা যায়, সে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি করতে পারলে পরবর্তী সময়ে এসব আপত্তির পরিমাণ কমে আসবে।
সূত্রমতে, বর্তমানে সরকারি মোট ব্যয়ের মাত্র ৭ শতাংশের ওপর অডিট করা সম্ভব হচ্ছে। বাকি ৯৩ শতাংশ ব্যয় অডিটের বাইরে থাকছে। এর একমাত্র কারণ, সিএজির লোকবলসহ সক্ষমতার অভাব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড হচ্ছে-সরকারি মোট ব্যয়ের ২০ শতাংশের ওপর অডিট করা। এটি করতে পারলে অনিয়মের প্রকৃত তথ্য বোঝা যাবে-এমন মন্তব্য করেছেন সিএজি কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।
সূত্রমতে, সর্বশেষ সরকরি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ১৭০ কোটি টাকা অর্থব্যয়ে অনিয়মের ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে দেখা যায়, এক্সিম ব্যাংক অনুমোদনসীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে। এছাড়া অনুমোদনযোগ্য নয়-এমন ব্যয় আয়ের সঙ্গে যোগ না করে মোট আয় নিরূপণ করেছে। এমন হিসাবনিকাশের কারণে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৪০ কোটি টাকা হয়েছে। এ টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমার নির্দেশ দেওয়া হয়। একইভাবে আরও আটটি অনিয়মের ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ জমার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব অর্থ এখনো জমা হয়নি।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত উপ-মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মো. আহসান হাবীব যুগান্তরকে জানান, সরকারি ব্যয়ে শতভাগ নিরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। ব্যয়ের একটি বড় অংশই নিরীক্ষার বাইরে থাকছে। তবে আপত্তির যে রিপোর্টগুলো জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়, সেটি একেবারেই শেষ পর্যায়ে। অডিট আপত্তিগুলো রিপোর্ট করার আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করা হয়। সেখানে অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলেই রিপোর্ট করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। অর্থ আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকরি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি এসব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে জড়িত অর্থ আদায়ের নির্দেশ দেন। এরপর প্রতিটি ঘটনার বিপরীতে রিপোর্ট ধরে আদায়কৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়। আর সেটি সম্ভব না হলে আইনি ব্যবস্থা অর্থাৎ মামলায় যেতে হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংক ও রাজস্ব খাত ঘিরে অনিয়ম বেশি হয়েছে। শুধু রাজস্ব খাতে অডিট আপত্তির অঙ্ক ৩২ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। ১০ হাজার ৮৯০টি আপত্তির বিপরীতে এই অর্থ জমা আছে। ব্যাংকিং খাতে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে অডিট আপত্তি আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১১-দুই অর্থবছরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছ থেকে অডিট আপত্তিজনিত প্রায় ২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা উদ্ধার হয়। একইভাবে ২০১১ থেকে ২০১৩-দুই অর্থবছরে অর্থ ফেরত আনা হয়েছে ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। পরবর্তী ২০১৩-২০১৫ অর্থবছরে টাকা ফেরত আনার অঙ্ক ২ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৫-২০১৭ অর্থবছর পর্যন্ত টাকা আদায়ের পরিমাণ ২ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এর পরবর্তী বছরগুলোয় অর্থ আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি। সিএজির সূত্রমতে, ২০১৭-২০১৯-এ দুই অর্থবছরে আদায়ের অঙ্ক ১৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা। আর ২০১৯-২০২১ অর্থবছরে ১৬ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আদায় হয়েছে ২ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা।
উদ্ধার করা অর্থের পরিমাণ কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মাসুদ আহমেদ মঙ্গলবার যুগান্তরকে জানান, অডিট আপত্তির অর্থ আদায়ের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। কাউকে আসামি হিসাবে চিহ্নিত করলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। সে প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর দোষী বা দোষী নয় রায় হবে। এটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পাশাপাশি সরকারি চাকরিজীবীরা ঘনঘন বদলি হন। যার সময় অডিট আপত্তি হয়েছে, তিনি বদলি হয়ে গেছেন। ফলে নতুন আসা কর্মকর্তা জবাব দিতে সময় নেন। তিনি আরও বলেন, অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তির কোনো আইন নেই। কিন্তু উন্নত দেশ, বিশেষ করে আমেরিকায় এ ধরনের আইন আছে।
সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী সরকারের ঘোষিত বাজেটের অর্থ প্রতিবছর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা ব্যয় করে থাকে। এক্ষেত্রে নিরীক্ষার মাধ্যমে অনিয়ম ও দুর্নীতি শনাক্ত করে সিএজি কার্যালয়। অনিয়ম ধরার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে সিএজি। ওই বৈঠকে সমাধান না হলে সিএজি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সেখানেও সমাধান না হলে এটি অডিট রিপোর্ট আকারে পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির কাছে। এরপর সেগুলো জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। সেখান থেকে নিষ্পত্তির জন্য চলে যায় সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির (পিএ) কাছে। সেখানে আলোচনায় আপত্তি যদি নিষ্পত্তি না হয়, সেক্ষেত্রে বিভাগীয় মামলা হয়। আর যেসব ঘটনায় সরাসরি দুর্নীতি ঘটে, সেগুলো পাঠানো হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে। দুদক সংশ্লিষ্ট অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এরপর আদালতের রায় নিয়ে টাকা আদায় করা হয় সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে। তবে মামলার আগেও অন্যান্য স্তরে আপত্তিগুলো নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। সেখান থেকে উদ্ধারের টাকাও কোষাগারে জমা হয়।