বিএসইসির ক্ষমতার অপব্যবহার
নির্দেশনা দিয়ে রুগণ কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তন
একটি নির্দিষ্ট চক্রকে সুবিধা দিতে এ আয়োজন * ঋণখেলাপির তালিকায় প্রতিষ্ঠানটি * অর্থনীতিবিদরা বলছেন অযৌক্তিক
মনির হোসেন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কারসাজির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে একটি নির্দিষ্ট চক্রকে বিশেষ সুবিধা দিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ক্ষমতার নজিরবিহীন অপব্যবহার করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সিদ্ধান্তের বিপরীতে লিখিত নির্দেশনা দিয়ে নামসর্বস্ব রুগণ কোম্পানি সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের ক্যাটাগরি পরিবর্তন করানো হয়েছে। এর ফলে সোমবার একদিনেই কোম্পানিটির ৫১ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১২ শতাংশ।
বিষয়টি নিয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা বিস্মিত ও হতবাক। বস্ত্র খাতের কোম্পানিটির ব্যাপারে তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন লোকসানে থাকা কোম্পানিটি ভবিষ্যতে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সংসদে অর্থমন্ত্রী ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের যে তালিকা দিয়েছেন, সেখানেও এ কোম্পানির নাম রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, অনেক আগে থেকে কিছু মানুষকে পরিকল্পিতভাবে কোম্পানিটির শেয়ার কেনানো হয়েছে। আর দাম বাড়িয়ে তাদের নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ দিতে বিএসইসির এ আয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের কাজ কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। তবে বিএসইসি বলছে, আইন মেনেই তারা সব কাজ করেছে। আর কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগে বন্ধ থাকলেও বর্তমানে পুরোদমে চালু হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, এক বছরের সামান্য লভ্যাংশ দেওয়ার মাধ্যমে কোনো কোম্পানির ভবিষ্যৎ বোঝা যায় না।
আগামী দিনে কোম্পানিটি কীভাবে আয় করবে, তা বুঝতে হলে আরও দুয়েক বছর কোম্পানির পারফরম্যান্স দেখা দরকার। ক্যাটাগরি পরিবর্তনের জন্য ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। এর আগে ক্যাটাগরি পরিবর্তন কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।
প্রসঙ্গত, স্টক এক্সচেঞ্জের সেটেলম্যান্ট রেগুলেশন আইন-২০১৩ অনুসারে শেয়ারবাজারে তিন ধরনের কোম্পানি রয়েছে-‘এ’, ‘বি’ ও ‘জেড’। যে কোম্পানি নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা করে এবং বিনিয়োগকারীদের ন্যূনতম ১০ শতাংশ লভাংশ দেয়, সেটি ‘এ’ ক্যাটাগরি।
১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দিলে ‘বি’ এবং এজিএম না করা ও লভ্যাংশ দিতে না পারলে সেটি ‘জেড’ ক্যাটাগরি। জেড ক্যাটাগরির কোম্পানির শেয়ারে কিছু অসুবিধাও রয়েছে। এসব কোম্পানির লেনদেন নিষ্পত্তি হতে তিন কার্যদিবস লাগে।
কোম্পানির শেয়ারে ঋণ পাওয়া যায় না। তবে ক্যাটাগরি পরিবর্তন হয়ে ‘বি’তে এলে আর সমস্যা থাকে না। আর এ সুযোগ নিয়েছে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল। কোম্পানিটির আগের উদ্যোক্তারা ঋণ নিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এরপর বিএসইসির নির্দেশে বোর্ড পুনর্গঠন হলে দায়িত্ব নেয় আলিফ গ্রুপ।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের নামসর্বস্ব কোম্পানি সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল। ২০১৬ সাল থেকে টানা সাত বছর কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী।
সেখানে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের নাম ৪১৭ নম্বরে রয়েছে। ওই তালিকায় কোম্পানিটির ৪৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ঋণখেলাপি দেখানো হয়েছে। বর্তমানে সেটি বেড়ে ২২৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এছাড়া ২০১৬ সালের পর থেকে কোম্পানিটি বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করতে পারেনি।
২০২০-২১ সালে কোম্পানিটির ১০ টাকার প্রতি শেয়ারের বিপরীতে লোকসান ছিল ৫ দশমিক ৭ টাকা। কিন্তু হঠাৎ ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য সালের কোম্পানিটি প্রতি শেয়ারের বিপরীতে ১০ পয়সা আয় দেখায়। কিন্তু এ আয়ের যৌক্তিক কোনো খাত অডিটরদের দেখাতে পারেনি।
কোম্পানির পুরোনো স্ক্র্যাপ বিক্রি করে আয় দেখানো হলেও বিনিয়োগকারীদের দেওয়া হয়েছে দশমিক ৪ পয়সা। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে জি কিবরিয়া অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কোম্পানিটির আর্থিক বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানির মোট পরিচালন লোকসান ৯ কোটি ৭৩ লাখ ৩ হাজার ৮৪১ টাকা। তবে অন্য আয় ১৫ কোটি ১ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। এ আয় কোথা থেকে এসেছে, এর ব্যাখ্যা পায়নি নিরীক্ষা কমিটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটি আগামী দিনে টিকে থাকতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। প্রতিবেদন তৈরির সময় কমিটিকে কোম্পানি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়নি। যতটুকু ডকুমেন্ট দেওয়া হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। কোম্পানির সাসপেনশন অ্যাকাউন্টে ১৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা নেতিবাচক। প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানির সুশাসনে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানি আর্থিক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কোম্পানির ট্রেড এবং অন্যান্য রিসিভাবল অ্যামাউন্ট ৪০ লাখ টাকা। আমানত ও ঋণের জন্য পরিশোধ ২০ কোটি ৭ লাখ, নগদ অর্থ ১ কোটি ৪২ লাখ, শেয়ার মূলধন ২৩৯ কোটি ৩১ লাখ, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ১৩৬ কোটি ৫৩ লাখ, স্বল্পমেয়াদি ঋণ ৮৮ কোটি ৯ লাখ, সেল রেভিনিউ ১ কোটি ৩৫ লাখ এবং কস্ট অব গুড সোল্ড বা পণ্য উৎপাদনে প্রাথমিক কাঁচামাল ক্রয় ১১ কোটি ৮ লাখ টাকা। তবে এসব তথ্যের কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি।
কোম্পানিটি ৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা শেয়ার মানি ডিপোজিটের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো ডকুমেন্ট তারা দেখাতে পারেনি। গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের বিপরীতে সম্পদমূল্য ৩ দশমিক ৬১ কোটি টাকা নেতিবাচক। অর্থাৎ কোম্পানির সম্পদ মাইনাস।
অডিটরদের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, দীর্ঘদিনের আর্থিক প্রতিবেদনের অভিজ্ঞতা অনুসারে বলা যায়, তাদের আর্থিক প্রতিবেদন মুনাফার তথ্যকে সমর্থন করছে না। এছাড়াও কোম্পানিতে যে নগদ টাকা আসছে, তা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট নয়। কোম্পানিতে হঠাৎ করে আয় দেখানো হয়েছে। কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিকল্পনা, সম্পদ এবং অপারেশনাল কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, এ কোম্পানি টিকে থাকা কঠিন।
ক্যাটাগরি পরিবর্তনের আবেদন এলে ডিএসই চিঠি দেয় বিএসইসির চেয়ারম্যানকে। চিঠিতে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএসইসির একটি নির্দেশনাকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, কোনো কোম্পানি দুই বছর লোকসান দিলে কোম্পানিটি জেড ক্যাটাগরিতে যাবে।
এক্ষেত্রে ২০২২ অর্থবছরে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের লোকসান ৯ কোটি ৭৩ লাখ টাকা এবং ২০২১ সালে ১০৩ কোটি টাকা। সে হিসাবে কোম্পানিটির জেড ক্যাটাগরিতে থাকা উচিত। কিন্তু ওই চিঠি আমলে নেয়নি বিএসইসি। কোম্পানির ক্যাটাগরি পরিবর্তনের জন্য ১৮ অক্টোবর দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে চিঠি দেয় বিএসইসি। চিঠিতে এক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাটাগরি পরিবর্তন করতে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ডিএসই একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান (অটোনমাস বডি)। কমিশন একটি গাইডলাইন দিতে পারে। কিন্তু হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান নিয়ম মেনেই ক্যাটাগরি পরিবর্তনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশনা একক কোনো কোম্পানির জন্য নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেকদিনের পরিকল্পনায় কোম্পানিটির ক্যাটাগরি পরিবর্তন করা হয়েছে। দুই বছর আগে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ছিল ৬ টাকার নিচে। ওই সময় কিছু লোককে কোম্পানির শেয়ার কেনানো হয়।
আর দাম বাড়িয়ে তাদের নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ দিতে এ আয়োজন। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশের কিছু শেয়ার রয়েছে। জড়িত রয়েছেন কমিশনের কিছু কর্মকর্তাও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিম উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানির আগের মালিকরা টাকা মেরে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। এরপর দীর্ঘদিন কোম্পানিটি বন্ধ ছিল।
আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। আল্লাহর রহমতে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সর্বশেষ প্রান্তিকে ৪ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। আশা করি, আগামী দিনে আরও বাড়বে। তিনি বলেন, কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। অডিটররা সেটিই উল্লেখ করেছেন। আমরা কোনো কিছু গোপন করিনি। তবে কোনোভাবেই কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানোর সঙ্গে ম্যানেজমেন্ট জড়িত নয়। কেন মানুষ শেয়ার কিনছে, তা আমার জানা নেই।
উল্লেখ্য, ক্যাটাগরি পরিবর্তনের পর সোমবার একদিনেই ডিএসইতে সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইলের ৫১ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। মঙ্গলবার ৮ কোটি ৫২ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের সর্বশেষ মূল্য ছিল ১০ টাকা ২০ পয়সা।