৩ নেতার গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন
ফটোসেশনের আন্দোলনে বরিশাল বিএনপি
কঠোর কর্মসূচি প্রশ্নে বরাবরই ব্যর্থ বরিশাল বিএনপি
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
হরতাল-অবরোধে তেমন মাঠে নেই বরিশালের বিএনপি। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া আন্দোলনের মাঠে দেখা মিলছে না প্রভাবশালী নেতাদের। কর্মী-সমর্থক যারা বিচ্ছিন্নভাবে মাঠে আছেন তারাও করছেন ফটোসেশনের আন্দোলন। ফলে হরতাল-অবরোধ সফল হয়নি এখানে। স্বাভাবিকভাবে চলেছে বাস-লঞ্চ। এদিকে হরতালের প্রথম দিনে সাবেক ২ এমপিসহ বিএনপির স্থানীয় তিন শীর্ষ নেতার গ্রেফতার নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে রহস্যের। নগরের চৌমাথা এলাকা থেকে এ তিন নেতার গ্রেফতারের বিষয়টি নিয়ে খোদ দলেই সৃষ্টি হয়েছে সন্দেহ। এ তিন নেতা সত্যিকার অর্থেই পুলিশি অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন নাকি গ্রেফতার হওয়ার উদ্দেশ্যেই সেখানে গিয়েছিলেন সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।
কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালনে দফায় দফায় গণজমায়েতের আয়োজনে সফল হলেও কঠোর কর্মসূচি প্রশ্নে বরাবরই ব্যর্থ বরিশাল বিএনপি। যার প্রমাণ আবারও মিলেছে কয়েকদিনের হরতাল-অবরোধে। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোর কোথাও একটি মিছিল পর্যন্ত করতে পারেনি তারা। অবরোধের শেষ দিনে বৃহস্পতিবার নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউদ্দিন সিকদারের নেতৃত্বে হওয়া ঝটিকা মিছিলের স্থানটিও ছিল বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়কের দপদপিয়া সেতুর ঢালে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি এলাকায়। এ সময় কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে দলের নেতাকর্মীরা। এর বাইরে নগরীর বটতলা ও বান্দ রোড এলাকায় মিছিল করেছেন ছাত্রদলের গুটি কয়েক নেতাকর্মী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা বিএনপির মিডিয়া গ্রুপে দেওয়া মিছিল ব্যারিকেডের কিছু ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর কোনোটিই নগরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো এলাকায় নয়। যদিও গ্রুপের তথ্যে কর্মসূচির স্থান উল্লেখ করা হয় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের কাশিপুর ও টিটিসিসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নাম। বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে মহানগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জাহিদুর রহমান রিপন দাবি করেন, আলোচ্য স্থানগুলোতেই এসব কর্মসূচি করেছে দলের নেতাকর্মীরা। তবে সরেজমিন ওইসব এলাকা ঘুরে তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি। কাশিপুর এলাকার ব্যবসায়ী আনিসুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ কিংবা অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলে অবশ্যই জানতাম। প্রায় একই কথা বলেন টিটিসি এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, হতে পারে তারা রাত ২-৩টার পর কিংবা কাকডাকা ভোরে এসব ঘটিয়েছেন। যখন রাস্তায় দূরপাল্লার ২-১টি গাড়ি ছাড়া কোনো যানবাহন থাকে না। সাধারণ মানুষও থাকে গভীর ঘুমে। নাহলে বিক্ষোভ হলো, গাছ ফেলা হলো, টায়ারে আগুন দেওয়া হলো অথচ কিছুই জানতে পারলাম না। এটা কী করে সম্ভব?
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বরিশাল কোতোয়ালি মডেল থানার এক কর্মকর্তা বলেন, এরকম কয়েকবার হয়েছে-ভোররাতে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখার খবর পেয়ে গিয়ে সরিয়েছে আমাদের টহল দল। কিন্তু ঘটনাস্থলে কাউকে পাওয়া যায়নি। আসলে এগুলো তো আন্দোলন নয়, ছবি তুলে সরবরাহ করে দলে অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা। এরকম ক্ষেত্রে দেখা যায়, টায়ারে কেরোসিন পর্যন্ত আগে থেকে লাগিয়ে নিয়ে আসা হয়। স্রেফ আগুন দেওয়া, ২-৪টি স্লোগান আর মোবাইলে ছবি তুলেই শেষ।
বরিশালে কর্মরত একাধিক ফটোসাংবাদিক বলেন, নেতারাই আমাদের খবর দেন নির্দিষ্ট একটি স্থানে যাওয়ার জন্য। হয়তো সেটা নগরীর উপকণ্ঠে নির্জন কোনো এলাকা। আমরা পৌঁছানোর পর গুটিকয়েক নেতাকর্মী বেরিয়ে আসেন। স্লোগান আর টায়ারে আগুন দিয়ে ছবি তোলা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার লুকিয়ে পড়েন সবাই। এরপর চলে গণমাধ্যমে ছবি ছাপানোর তদবির। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই আমরা। কিন্তু এটা ঠিক যে আন্দোলন বলতে এখন এমনটাই হচ্ছে। পুলিশি অভিযানের হাত থেকে বাঁচার জন্য এভাবে ফটোসেশন করার কারণ হচ্ছে কেন্দ্রকে জানানোর চেষ্টা যে বিশাল কিছু হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই না। মূলত হাইকমান্ডকে এভাবে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে দলে অবস্থান পাকাপোক্ত করা আর পদপদবি নিশ্চিতের জন্যই চলছে এসব।
এ বিষয়ে জানতে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রায় সবার ফোন বন্ধ থাকায় কথা বলা যায়নি।
এদিকে অবরোধের প্রথম দিন মঙ্গলবার ভোরে নগরীর চৌমাথা এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়া যে তিন নেতাকে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে তারা হলেন-সাবেক এমপি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন, সাবেক এমপি বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান ও বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক। পরিচয় না প্রকাশের শর্তে মহানগর বিএনপির এক নেতা বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন প্রশ্নে সবসময় বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে চলে মহানগর। দক্ষিণ জেলার সঙ্গে মহানগর নেতাদের দূরত্ব সবার জানা। সেখানে মহানগর আর দক্ষিণ জেলা বিএনপির দুই আহ্বায়ক একসঙ্গে হওয়ার বিষয়টি রহস্যজনক। গ্রেফতারের ঝুঁকি আছে জেনেও এ তিন নেতা একসঙ্গে কেন সেখানে গেলেন সেই প্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না। তবে কি বিষয়টি এরকম যে আন্দোলন-সংগ্রামের ঝামেলায় না থেকে গ্রেফতার হয়ে জেলে থাকাটাই নিরাপদ মনে করেছেন তারা?
গ্রেফতার হওয়ার পর কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে শিরিনকে ভর্তি করা হয় শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। উল্লেখ্য, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান ১৫ বছরের শাসনামলে এ-ই প্রথম গ্রেফতার হলেন শিরিন। নতুন কোনো মামলা না দিয়ে পুরোনো মামলায় তাদের জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ।