Logo
Logo
×

শেষ পাতা

আসছে শীতের মৌসুম 

গ্যাসের আগুনে বাড়ছে দুর্ঘটনার শঙ্কা

তিন বছরে গ্যাস সরবরাহের লাইনে ২,৩০৬ আগুন, সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ ৩৩৪টি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

গ্যাসের আগুনে বাড়ছে দুর্ঘটনার শঙ্কা

ভয়ের বার্তা দিচ্ছে গ্যাসের আগুন। লাইনের গ্যাসের পাশাপাশি এলপিজি সিলিন্ডারও এখন শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই গ্যাসের আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়েই চলছে। এতে কোটি কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। গত তিন বছরে গ্যাস সরবরাহ লাইনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৩০৬টি। এই সময়ে সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ হয়েছে ৩৩৪টি। এছাড়া চুলা থেকে গত তিন বছরে ১০ হাজার ৮৫৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বদ্ধ ঘরে গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতিতে যে কোনো উৎস থেকে তৈরি আগুনের স্ফুলিঙ্গ এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। তদারক সংস্থাগুলোর গাফিলতি এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতার অভাবে ছোটখাটো ভুল থেকে দুর্ঘটনা বড় হয়ে যাচ্ছে। গ্যাস সংকটের কারণে আসছে শীতে সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়বে। এ অবস্থায় বছরের অন্য সময়ের চেয়ে গ্যাস থেকে দ্বিগুণ দুর্ঘটনার ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পরিসংখ্যান বলছে, গ্যাসলাইন বা সিলিন্ডার কেন্দ্র করে দিনে গড়ে তিনটির বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের শুরুতে রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২৫ জনের মৃত্যুর ঘটনার মূলেও ছিল জমে থাকা গ্যাস। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে উঠে আসে, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির পরিত্যক্ত লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাস জমে ভবনের বেজমেন্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ঢাকার এমন আরও সাতটি বড় বিস্ফোরণের ঘটনার মূলেও ছিল জমে থাকা গ্যাস। 

এই দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বদ্ধ রুমে মিথেন গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। মিথেনের সঙ্গে হাইড্রোজেন সালফাইড যুক্ত হয়ে গ্যাস বিস্ফোরণকে আরও শক্তিশালী করেছে। এতে ধসে গেছে অনেক ভবন। বিস্ফোরণের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, আশপাশের স্থাপনাও কাঁপিয়ে দেয়। সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চাপ, তাপ ও ছিদ্র থেকেই ঘটছে দুর্ঘটনা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, গ্যাসের আগুন ও বিস্ফোরণের উৎস গ্যাস সিলিন্ডার ও লাইনের গ্যাস। বড় বিস্ফোরণের ঘটনাগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সেখানে গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস জমা হয়। 

মিথেন গ্যাস দাহ্য পদার্থ। বদ্ধ রুমের বাতাসে ৫-১৫ শতাংশ অথবা তার চেয়ে বেশি মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে কোনো স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ), ম্যাচের কাঠি বা আগুনের উৎস থাকলেই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অনেক সময় মিথেনের সঙ্গে যুক্ত হয় হাইড্রোজেন সালফাইড। যা নিজে দাহ্য না হলেও অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য হয়। মিথেন ও হাইড্রোজেন সালফাইড এক হয়ে বেড়ে যায় দাহ্যতা। সে কারণে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হয়। এতে ভবনও ধসে যেতে পারে। মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করলে যেসব উৎস থেকে গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে এর সবগুলোই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে ৭২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ হয় ১৩৫টি। এই দুই ধরনের দুর্ঘটনায় এ বছর ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৮৭ লাখ ৯৯ হাজার ১৭০ টাকার সম্পদ। ২০২১ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইনে ৭৮৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ হয় ১০৫টি। এতে ক্ষতি হয় ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩৫ টাকার সম্পদ। সর্বশেষ ২০২২ সালে গ্যাস সরবরাহ লাইন থেকে ৭৯৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণ হয় ৯৪টি। এতে ক্ষতি হয় ৪ কোটি ৪৩ লাখ ২৫ হাজার ১৪৫ টাকার সম্পদের। সব মিলিয়ে তিন বছরে ক্ষতি হয় ১২ কোটি ২০ লাখ ৮৩ হাজার ৫০ টাকার।

সিলিন্ডার দুর্ঘটনার বিষয়ে অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, এক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব সবচেয়ে বেশি দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দুর্ঘটনাকবলিত সিলিন্ডারগুলো পুরোনো। এগুলো মরিচা ধরে ছিদ্র হয়ে বাইরে গ্যাস জমে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি গ্যাস ভর্তি করলে অথবা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় গ্যাস ধারণের ক্ষমতা হারিয়েও সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। অনেকে আবার বাসাবাড়িতে চুলার কাছে সিলিন্ডার স্থাপন করেন। এতে সরাসরি সিলিন্ডারে তাপ প্রবাহিত হয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। কেউ কেউ অসাবধানতাবশত সিলিন্ডারের রেগুলেটর বন্ধ করতে ভুলে যায়। এভাবে গ্যাস বাইরে এসেও ঘটে দুর্ঘটনা।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, গ্যাসের অধিকাংশ লাইন পুরোনো। এসব লাইনের ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ থেকে গ্যাস বের হয়ে বাতাসে মেশে। তখন এটা এক্সপ্লোসিভে (বিস্ফোরক) পরিণত। এ অবস্থায় যে কোনো উৎস থেকে একটা স্পার্ক পেলেই দুর্ঘটনা ঘটে। আর সিলিন্ডার গ্যাসের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটে প্রধানত মানহীন রেগুলেটর থেকে গ্যাস বের হয়ে। দীর্ঘক্ষণ গ্যাসের মধ্যে থাকায় অভ্যস্ত হয়ে যায় বলে লিকেজের বিষয়ও বুঝতে পারে না। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। এজন্য বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও রান্নাঘর বন্ধ নয়, পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থার ওপর জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় পর বাসায় এসে সরাসরি বৈদ্যুতিক সুইচ, মশা মারার ব্যাট বা স্পার্ক হয় এমন কিছু না টিপে দরজা-জানালা খুলে কিছুক্ষণ পর সংযোগ চালুর পরামর্শও তাদের।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। গ্যাস সিলিন্ডার নিয়মিত চেক করা প্রয়োজন। গ্যাসের গন্ধ পেলে কোনো বৈদ্যুতিক সুইচ চালু করা যাবে না। লাইনের গ্যাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি তিতাসকে অবহিত করতে হবে। তিতাসকেও নিয়মিত লাইনগুলো পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করতে হবে। এছাড়া গ্যাসলাইনের ম্যাপিং প্রয়োজন। ত্রুটিপূর্ণ লাইন মেরামত, মানসম্পন্ন সামগ্রীর ব্যবহার, ‘অটো শাটডাউন সিস্টেম’ চালু অতীব জরুরি। 

দুর্ঘটনাগুলো কমিয়ে আনতে অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। সেগুলো হলো-গ্যাসলাইনের লিকেজসহ অন্যান্য দুর্বলতা দূর করতে হবে। যেই উৎসগুলো থেকে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, তার তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে। এগুলোর পরিপূর্ণ ডাটাবেজ নেই। ফলে নিয়মিত মনিটরিং হয় না। কোথাও কোথাও কখনোই মনিটরিং হয় না। এজন্য একটা পরিপূর্ণ ডাটাবেজ এবং এর একটা ম্যাপিং থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাহলে পরিদর্শকদের তদারকিতে ঘাটতি হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হায়ার অথরিটির কাছে বার্তা যাবে।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম