Logo
Logo
×

শেষ পাতা

কাঙ্ক্ষিত সুবিধা না পেয়ে অমানবিক আচরণ

মামলা তদন্তে পুলিশের অনৈতিক আবদার

মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগও রয়েছে * তদন্ত সঠিক না হলে ন্যায়বিচার পেতে বিলম্ব হয়-পিপি আবদুল্লাহ আবু * অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে-সাবেক আইজিপি শহীদুল হক

Icon

ইমন রহমান

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মামলা তদন্তে পুলিশের অনৈতিক আবদার

রাজধানীর মহাখালী সাততলা সংক্রামক ব্যাধি জামে মসজিদের সামনে থেকে গত বছরের ১২ আগস্ট চুরি হয় দুই বছরের শিশু মো. ইব্রাহিম। এ ঘটনায় শিশুটির বাবা রানা মিয়ার করা মামলাটি থানা পুলিশ ও ডিবির পর এখন তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রানা মিয়ার অভিযোগ, সন্তান হারিয়ে যখন তিনি দিশেহারা ঠিক সেই মুহূর্তে ইব্রাহিমকে উদ্ধারের জন্য মামলা তদন্তের খরচ দাবি করেন পিবিআই’র তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি কোনো টাকা না দেওয়ায় থমকে যায় শিশুটিকে উদ্ধারে পুলিশের তৎপরতা।

পুলিশের মাঠপর্যায়ের কিছু সদস্যের করা এমন অনৈতিক আবদার না রাখার প্রভাব পড়ছে মামলার তদন্তে। তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, পক্ষপাতিত্ব, ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, ভুক্তভোগীর সঙ্গে খারাপ আচরণ, মামলার চার্জশিট থেকে মূল আসামির নাম বাদ দেওয়াসহ অসংখ্য ঘটনা প্রায়সই ঘটছে। এতে ন্যায়বিচার পেতে অনেক সময় লাগছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট মো. আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, নির্ভুল ও সঠিকভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে। তা না হলে অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। সেক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পেতে কিছুটা বিলম্ব হয়। অধিকাংশ ভুক্তভোগী জানান, ঝামেলা এড়াতে কোনো অভিযোগ করেন না তারা। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী যুগান্তরকে তাদের অসন্তোষের কথা জানিয়ে বলেছেন, তারা নিরুপায় হয়ে মামলাটি পুলিশের অন্য সংস্থায় স্থানান্তর করেছেন।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক যুগান্তরকে বলেন, পুলিশের নিজস্ব গোয়েন্দা দিয়ে অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গতিবিধি, কার্যকলাপ যদি মনিটরিং করা হয় এবং টাইম টু টাইম রিপোর্ট দেওয়া হয়, তাহলে অপরাধ কমে আসবে। তিনি বলেন, অভিযোগ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বনানী থানায় শিশু চুরির মামলা করেন বাবা রানা মিয়া। চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ। রানা মিয়া জানান, তিনি মহাখালী কলেরা হাসপাতালের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট। পিবিআই তদন্তভার পাওয়ার প্রায় তিন মাস পর চলতি বছরের ১০ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. কবির হোসেন কলেরা হাসপাতালের ক্যান্টিনে তার সঙ্গে বসেন। মামলার বিভিন্ন বিষয়ে আলাপকালে এসআই কবির তার কাছে মামলা তদন্তের খরচ চান। কিন্তু কোনো খরচ দেননি রানা মিয়া।

গত ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে এ প্রতিবেদকের সামনে এসআই কবিরকে ফোন করে রানা মিয়া বলেন, মামলা তদন্তের জন্য খরচ চাইলেন, আমি টাকা না দেওয়ায় আর কোনো যোগাযোগই করছেন না আপনি। এ সময় এসআই কবির প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে ফোন কেটে দেন। কিছু সময় পরে রানা মিয়া আবার ফোন করলে এসআই কবির বলেন, ‘আমরা বাচ্চা পাইলে একসঙ্গে মিষ্টি খেতে পারব না? তখন আমি আপনাকে বলব ভাই গাড়ির ব্যবস্থা (গাড়ি ভাড়া করা) করেন বাচ্চা আনতে যাব।’ এসব কথোপকথনের অডিও রেকর্ড রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ১৩ অক্টোবর এসআই কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি কোনো টাকা দাবি করি নাই।’ যুগান্তরের কাছে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড আছে বলার পর তিনি বলেন, ‘স্লিপ অব টাং হতে পারে।’

সাভার বাজার রোডে ভাড়া বাসার পাশের সরু গলি থেকে ২ আগস্ট সকালে আব্দুল খালেক নামের এক ব্যবসায়ীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন খালেকের স্ত্রী মোসা. রমুজা বেগম। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান সাভার মডেল থানার এসআই মামুন কবীর।

নিহত খালেকের মেয়ে আম্বিয়া খাতুন যুগান্তরকে বলেন, এসআই মামুন বাবার খুনিকে খুঁজে বের করার জন্য আর্থিক সুবিধা নিতে বিভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমরা তখন কোনো ধরনের টাকা-পয়সা দেইনি তাকে। পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন আলামত তিনি নষ্ট করেছেন। সব সিসিটিভির ফুটেজ নষ্ট করেছেন। আমরা আবেদন করে মামলাটি পিবিআইতে নিয়েছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মামুন যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগ সত্য নয়। আমি কোনো আলামত নষ্ট করিনি।

রাজধানীর ভাসানটেকের বাসিন্দা সালমা আক্তারের বাড়ির জমি নিয়ে প্রতিবেশী স্বপন কুমার রায়ের সঙ্গে বিরোধ বাধে। ২০১৭ সালের ২ মে ঢাকার দ্বিতীয় সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করেন সালমা। বিবাদী স্বপন কুমার একটি সমঝোতার চুক্তিপত্র আদালতে উপস্থাপন করেন। আদালত গত বছরের জানুয়ারি মাসে ওই চুক্তিপত্র আসল না জাল তা তদন্তের নির্দেশ দেন ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি)।

সালমা ইসলামের অভিযোগ, ডিবি মিরপুর বিভাগের ইন্সপেক্টর খন্দকার হাফিজুর রহমান তদন্তের খরচ বাবদ তিন কিস্তিতে তার কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নেন। পরে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। কিন্তু তিনি আর টাকা দেননি। পরবর্তীতে প্রতিবেদনটি সালমা ইসলামের বিরুদ্ধে দেন ইন্সপেক্টর হাফিজুর। গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে পশ্চিম ভাসানটেকের বাসায় গিয়ে কথা হয় সালমা আক্তারের সঙ্গে। এ সময় তিনি ইন্সপেক্টর হাফিজুরকে ফোন করে টাকা ফেরত চাইলে হাফিজুর বলেন, আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন।

ইন্সপেক্টর হাফিজুরকে ফোনে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভুল নম্বরে ফোন করেছেন। এরপর একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। ডিবি মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মানস কুমার পোদ্দার যুগান্তরকে বলেন, ইন্সপেক্টর হাফিজুর ডিবি থেকে বদলি হয়ে কিশোরগঞ্জে চলে গেছেন। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এখনো আমাদের কাছে আসেনি।

গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর খুন হন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সুমন খান। মুকসুদপুর থানায় নিহতের ভাই রুহুল আমিন খান রিপন বাদী হয়ে মামলা করেন। রুহুল আমিনের অভিযোগ, মামলার তদন্তকালে আসামি পক্ষের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুস নিয়ে এজাহারনামীয় এক নম্বর আসামিসহ চার জনের নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন ইন্সপেক্টর আমিনুর।

রুহুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, পিবিআই পুনরায় তদন্ত করে মূল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। আমি ইন্সপেক্টর আমিনুর রহমানের বিরুদ্ধে আইজিপির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। ইন্সপেক্টর আমিনুর বর্তমানে গোপালগঞ্জ থানায় ইন্সপেক্টর তদন্ত হিসাবে দায়িত্বে আছেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সঠিক নয়।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম