চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুদক কর্মকর্তার মৃত্যু
দুই এএসআই প্রত্যাহার মামলাটি ছিল মিথ্যা
বাদীর মোবাইল কললিস্টের সঙ্গে ঘটনাস্থলের মিল নেই
আহমেদ মুসা, চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
নিহত দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ
চট্টগ্রামে পুলিশ হেফাজতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক উপপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুর ঘটনায় চান্দগাঁও থানার দুই এএসআইকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন ও অর্থ) এমএ মাসুদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। তাদের প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রত্যাহার হওয়া দুই এএসআই হলেন মো. ইউসুফ আলী ও এটিএম সোহেল রানা। তারা দুদকের সাবেক এই কর্মকর্তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সিভিল পোশাকে গিয়ে মঙ্গলবার রাতে ধরে নিয়ে এসেছিলেন। থানায় আনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ওই কর্মকর্তা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি সাজানো মামলায় দুদকের এত বড় একজন কর্মকর্তাকে সামান্য দুজন এএসআই গিয়ে এভাবে ধরে আনার ঘটনাটি অস্বাভাবিক। তাছাড়া ওই কর্মকর্তাকে থানার ওসি খাইরুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। তার সঙ্গে জমিজমা নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে যে বিরোধ ছিল সেটিও জানতেন।
এরপরও তিনি কেন ওই কর্মকর্তাকে একটি ভুয়া মামলায় গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করেননি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রনি আক্তার নামে যে নারী বাদী হয়ে আদালতে শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন, এজাহারে মারধর করা এবং হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ এনেছেন সেই নারীকে শহিদুল্লাহ চিনতেনই না। ওই নারীর মোবাইল কললিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এজাহারে বর্ণিত ঘটনার তারিখ ও স্থান অনুযায়ী ওই নারী সেদিন ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। তাছাড়া শহিদুল্লাহর গৃহকর্মী উল্লেখ করা হলেও ওই নারী কখনোই শহিদুল্লাহর বাসার কাজের মেয়ে বা গৃহকর্মী ছিলেন না। শহিদুল্লাহর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর কয়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোনে সাড়া দিলেও এরপর থেকে আর তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এজাহারে দেওয়া ঠিকানায় গিয়েও তার হদিস পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুদক কর্মকর্তা শহিদুল্লাহর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম আদালতে মামলাটি (নম্বর : ৭৩৩/২৩) করা হয়েছিল ২৯ আগস্ট। মামলার এজাহারে দুটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে একটি ঘটনা দেখানো হয় ১২ আগস্ট। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি দেখানো হয় ২৩ আগস্ট। তবে দুটি ঘটনারই পিও বা ঘটনাস্থল দেখানো হয় মোজাহের উল্লাহ মুহুরীর বাড়ি, ১ কিলোমিটার, পূর্বষোলশহর, থানা চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম। এটি দুদকের সাবেক কর্মকর্তা শহিদুল্লাহর বাড়ি। এটি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, তিনি শহিদুল্লাহর বাসার গৃহকর্মী হিসাবে ৩ হাজার টাকায় কাজ নিয়েছিলেন। কাজের বেতন বাবদ তিনি ৬ হাজার ৫০০ টাকা পাওনা হন। ১২ আগস্ট ওই টাকা আনতে গেলে শহিদুল্লাহ বলেন, তোমাকে ভবনের নিচে একটি রুম ঠিক করে দেব। তখন আর ভাড়া দিতে হবে না এবং বকেয়া টাকাও পরিশোধ করে দেবেন। মামলায় দ্বিতীয় ঘটনা উল্লেখ করা হয় ২৩ আগস্ট রাত আনুমানিক ৮টা ৩০ মিনিট। বাদী বলেন, বকেয়া টাকা চাইতে গেলে শহিদুল্লাহ তাকে গলা টিপে ধরেন। মারধর করেন। তার সঙ্গে থাকা কলি আক্তার নামে এক মহিলাকেও লাথি দেন।
এজাহারে বর্ণিত দুটি ঘটনার তারিখ ও সময়ে বাদীর মোবাইল ফোনের (০১৮৭২-৫৮৫৩৫৫) কললিস্ট সংগ্রহ করে যুগান্তর। বাদীর মোবাইল ফোনের কললিস্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১২ আগস্ট এবং ২৩ আগস্ট বাদী রনি আক্তার তানিয়ার অবস্থান ছিল ১৮ নম্বর ওয়ার্ড, বাকলিয়া থানা এলাকায়। আর যে স্থানে ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে সেটি ছিল চান্দগাঁও থানার ৬ নম্বর ওয়ার্ডে। মোবাইল কললিস্টই বলে দেয়, কথিত সময় ও তারিখে বাদী শহিদুল্লাহর বাসার ধারেকাছেও যাননি। এতেই ওই মামলাটি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে প্রমাণিত। তবে মামলা দায়েরের দিন বাদী রনি আক্তার তানিয়া সকাল ১০টা ১০ মিনিটে চট্টগ্রাম আদালত এলাকার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করেন।
নারীর দায়ের করা মামলার ওয়ারেন্ট বলে মঙ্গলবার রাতে দুদকের সাবেক উপসহকারী পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শহিদুল্লাহকে তার বাসার পাশে রাস্তা থকে ধরে নিয়ে আসেন এএসআই মো. ইউসুফ আলী ও এটিএম সোহেল রানা। দুদকের সাবেক কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়ার পরও তার কোনো কথা শুনতে চাননি তারা। থানায় আনার পর স্বজনরা হৃদরোগে আক্রান্ত দুদক কর্মকর্তার কাছে ইনহেলার পৌঁছাতে চাইলে তাও পৌঁছাতে দেননি তারা। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে এসআই আমিনুল ইসলামকে দিয়ে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু পথেই দুদক কর্মকর্তা মারা যান।
গ্রেফতারকারী দুই এএসআইকে থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হলেও অপর এসআই আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, এসআই আমিনুল ইসলামও মামলা বাণিজ্য করেন। চান্দগাঁওয়ের মোহরায় ভাড়াটিয়া-জমিদার বিরোধে লিটু ধর নামে এক বাড়ির মালিককে মধ্যরাতে ঘুম থেকে ধরে নিয়ে এসে মিথ্যা মামলায় চালান দেন। ওসি খাইরুল ইসলামকে এ বিষয়ে অভিযোগ দিলেও তিনি কোনো প্রতিকার করেননি।