কালুরঘাটে ফেরি সার্ভিস
জেদাজেদি করে উচ্চ দরে টেন্ডার নিয়ে এখন অনাগ্রহ
শহীদুল্লাহ শাহরিয়ার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সাত দফা টেন্ডার আহ্বানের পর অবশেষে তিন বছরের জন্য কালুরঘাটে ফেরি সার্ভিস চালাতে ইজারাদার নির্বাচন করেছে চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগ। সর্বশেষ ‘আমরিন অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে দুই কোটি ১৪ লাখ টাকায় সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে এই সার্ভিস ইজারা দিতে সুপারিশ করেছে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। প্রথম দফায় একজন মাত্র দরদাতা ৬০ লাখ টাকা ইজারা দর উল্লেখ করেন। কিন্তু জেদাজেদি ও অভিযোগ-পালটা অভিযোগের কারণে একে একে সাত দফা টেন্ডার আহ্বান করতে হয় সড়ক বিভাগকে। তবে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে যে প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দিতে সুপারিশ করা হয়েছে সেই ইজারাদারের লোকজনই এখন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ কারণে তারা আদৌ কার্যাদেশ নেবেন কিনা সে বিষয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে সড়ক বিভাগ।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন বছরের জন্য ফেরি সার্ভিস ইজারা দেওয়া হলেও এর মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত হবে। অর্থাৎ নতুন আরেকটি সেতু নির্মাণ না হওয়া পর্যন্ত কালুরঘাটে ফেরি সার্ভিস অব্যাহত থাকবে। এ কারণে সহসাই ঘুচবে না চান্দগাঁও-বোয়ালখালী-পটিয়ার লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগ। যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে সারা দেশে নদী থেকে যেখানে ফেরি সার্ভিস একে একে উঠে যাচ্ছে সেখানে কর্ণফুলী নদীর কালুরঘাটে ফিরে এসেছে ফেরি! কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি গত ১৫ বছর ধরেই জোরালো ছিল। এই এলাকার প্রয়াত দুই সংসদ-সদস্যের একজন মইনুদ্দিন খান বাদল। তিনি কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের ঘোষণা না এলে সংসদ থেকেই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এমপি মোছলেম উদ্দিন আহমেদের প্রধান নির্বাচনি অঙ্গীকার ছিল নতুন সেতু বাস্তবায়ন। কিন্তু চট্টগ্রামে অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও কালুরঘাটে নতুন সেতু প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়নি। যার খেসারত এখন ফেরি দিয়েই দিতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে।
সর্বশেষ দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লেন ডুয়েল গেজ রেললাইন ও ডাবল লেন সড়ক সেতু নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এই প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৮ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যথাসময়ে কাজ শুরু হলে আরও অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে নতুন সেতু পেতে। ততদিন ফেরি সার্ভিসেই ভরসা করতে হবে।
কালুরঘাটে ১৯৩০ সালে নির্মিত বর্তমান সড়ক-কাম রেল সেতুটি জরাজীর্ণ হওয়ায় ২০০১ সালে এটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। এই সেতুর ওপর দিয়ে ১০ টনের ভারী যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। দোহাজারী থেকে টেকনাফের ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার পর ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজারে রেল যোগাযোগ চালুর চিন্তা করছে সরকার। এ জন্য বিদ্যমান কালুরঘাট রেল সেতু সংস্কারকাজ শুরু করে। গত ১ আগস্ট থেকে এই সেতুর ওপর দিয়ে তিন মাসের জন্য যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিকল্প হিসাবে ২১ জুলাই থেকে ফেরি সার্ভিস চালু করা হয়। এই সেতু দিয়ে বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-পটিয়ার আংশিক এলাকার অন্তত ১০ লাখ মানুষ পারাপার করে।
সূত্র জানায়, ফেরি সার্ভিস পরিচালনার জন্য সড়ক বিভাগ ইজারাদার নিয়োগে সাত দফা টেন্ডার আহ্বান করে। এতে ১৪টি কোটেশন পাওয়া যায়। সপ্তম দফায় ইজারা দর ওঠে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই দর দেয় আকতার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সপ্তম দফায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয় আমরিন অ্যান্ড ব্রাদার্স। তারা দর দেয় এক কোটি ৭১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৮৬ টাকা। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ যা গিয়ে দাঁড়ায় দুই কোটি ১৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকায়। আকতার এন্টারপ্রাইজ ইজারা মূল্যের ১০ শতাংশ জামানতের পে-অর্ডার না দেওয়ায় তা বাতিল করা হয়। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি আমরিন অ্যান্ড ব্রাদার্সকে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে নির্বাচিত করে।
চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক পিন্টু চাকমা যুগান্তরকে বলেন, আমরা মূল্যায়িত সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে আমরিন এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দিতে সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। বাকিটা মন্ত্রণালয় দেখবে।
বর্তমানে সড়ক বিভাগ ফেরিঘাটের টোল আদায় করছে। এতে দেখা গেছে, গড়ে প্রতিদিন ৬৫ হাজার টাকা টোল আদায় হচ্ছে। ফেরি পরিচালনার দৈনন্দিন তেল মবিল হাইড্রলিকসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় শেষে প্রতি মাসে নিট আয় দাঁড়াচ্ছে চার লাখ ৩৯ হাজার টাকার মতো। যা বর্তমান দরদাতার প্রদত্ত দরের চেয়ে এক লাখ ৫৭ হাজার টাকার মতো কম। অন্যদিকে মেরামতের পর যদি কালুরঘাট সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন পারাপার সীমিত আকারেও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় তবে টোল আদায়ের পরিমাণ আরও হ্রাস পাবে। এতে দরদাতা প্রতিষ্ঠানের ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হবে।
এদিকে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসাবে কার্যাদেশের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন এখন ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছে। যদিও সড়ক বিভাগ বলছে, জামানতের টাকা থাকায় এতে সরকারের কোনো ক্ষতি হবে না। এ প্রতিষ্ঠান না আসলে তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচন করা হবে।