বিতর্কিত নেতাকে ‘গুরু’ মানতে অনীহা
সাজানো মামলায় তছনছ কলেজছাত্রের জীবন
মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাকার উপকণ্ঠ গাজীপুরে ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র রবিন সরদার। কলেজ ক্যাম্পাসে জনপ্রিয় রবিন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। দীর্ঘদিন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি না থাকলেও তিনি নেতৃস্থানীয়। তার ডাকে হাজারো শিক্ষার্থী যোগ দেয় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। এই জনপ্রিয়তাই তার জন্য কাল। তাকে নিজেদের গ্রুপে ভেড়াতে চান আওয়ামী লীগের স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও বিতর্কিত এক নেতা। কিন্তু পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করতে ইচ্ছুক রবিন তাকে ‘গুরু’ মানতে অনীহা প্রকাশ করেন। এরপর থেকেই আটকাতে থাকেন সাজানো মামলার জালে।
জানা যায়, গত ছয় বছর খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ও মাদকের মোট ২৭ মামলায় রবিনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে সাতবার। একবার বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঘেরাও দিয়ে পুলিশের কাছ থেকে তাকে ছাড়িয়ে নেয়। বাকি ছয় দফায় এক বছরের বেশি সময় কারাবন্দি ছিলেন। ২৭ মামলার মধ্যে ১৪টির তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। তদন্তাধীন ৬ মামলা। আর সাত মামলার বিচারে রবিনকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।
এবার তাকে ধর্ষণ মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কুৎসিত এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও পুলিশি হয়রানির হাত থেকে বাঁচতে নীরবে একাই লড়ছেন রবিন। সবশেষ বিস্ফোরক মামলায় ২৩ দিন কারাবন্দি থাকার পর জুনে জামিনে মুক্তি পান। সম্প্রতি মামলার নথিপত্র দেখিয়ে রবিন যুগান্তরের কাছে বর্ণনা করেছেন তার ওপর ধারাবাহিক হয়রানিমূলক মামলা ও পুলিশি নির্যাতনের নির্মম কাহিনি। মামলার নথিপত্র ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে উল্লিখিত তথ্য।
আলাপকালে মো. রবিন সরদার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি গভীর চক্রান্তের শিকার। আমাকে অপরাধী হিসাবে প্রমাণের অপচেষ্টা চলছে। আমার ছবি থানার তালিকাভুক্ত দাগি অপরাধীদের বোর্ডে লাগিয়ে ডাকাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, মোটা টাকার বিনিময়ে এসব অপকমের্র অংশীদার গাজীপুরের বাসন ও সদর থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রফিকুল ইসলাম। ২০২০ সালের জুনে তার পরিকল্পনায় তিন দিনের ব্যবধানে আমার নামে ছয়টি মামলা দেওয়া হয়। ওসি রফিকুল বদলি হয়ে গাজীপুর সদর থানায় গিয়ে সেখানেও আমার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দেন। অস্ত্র মামলা সাজানোর ঘটনা ফাঁস হলে তাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। অস্ত্র মামলায় সাত মাস কারাবন্দি থেকে বের হওয়ার ২০ দিনের মাথায় আমাকে ফের গ্রেফতার করে বিস্ফোরক মামলায় আসামি করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। ২৩ দিন কারাবাসের পর জামিন পাই।’
জানতে চাইলে বাসন ও গাজীপুর সদর থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (বর্তমানে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা-ডিবিতে কর্মরত) ইনস্পেকটর মো. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘রবিন সরদার ছাত্রলীগের রাজনীতি করে। আমি ওর বিরুদ্ধে মামলা দিতে যাব কেন? সংক্ষুব্ধরা অভিযোগ নিয়ে এলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কারও কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাকে সাজানো মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ ঠিক না। ডাকাত পরিচয়ে রবিনের ছবি থানার দাগি অপরাধীদের বোর্ডে টানিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও মিথ্যা।’ অথচ অপরাধীদের বোর্ডে ছাত্রলীগ নেতা রবিনের ছবি টানানোর প্রমাণও যুগান্তরের হাতে রয়েছে।
সরেজমিন জানা যায়, শিল্প এলাকা গাজীপুরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২২ হাজার। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি আবাসিক হোস্টেলও রয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পাশে অবস্থিত এই কলেজের ছাত্ররাজনীতির নিয়ন্ত্রণ যখন যার হাতে থাকে, তখন গাজীপুরজুড়েই থাকে তার প্রভাববলয়। ২০১৫ সালের ২৯ জুলাই সবশেষ সজীব হোসেন সবুজকে সভাপতি ও মোশারফ হোসেন সৌরভকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি ঘিরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। দুপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এর জেরে তখন সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ওই অবস্থায় রবিন সরদার দলীয় কর্মী-সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ করে নেতৃত্ব দিতে থাকেন। রবিনের রাজনৈতিক দূরদূর্শিতা দেখে তার ওপর নজর পড়ে স্থানীয় প্রভাবশালী বিতর্কিত এক রাজনৈতিক নেতার। নিজের ইমেজ রক্ষায় ওই নেতার গ্রুপে যোগ দেওয়ার জন্য রবিনের ওপর চাপ আসে। কিন্তু রবিন যোগ না দেওয়ায় ২০১৭ সালে তাকে প্রথম মামলার জালে ফাঁসানো হয়। এরপর থেকে পুলিশি হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে বেশির ভাগ সময় তিনি বাড়িছাড়া।
কলেজে যাওয়াও একরকম বন্ধ। নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুনে তিন দিনের ব্যবধানে তার বিরুদ্ধে বাসন থানায় ছয়টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি মামলাই চাঁদাবাজির। এসব মামলার এজাহার প্রায় অভিন্ন। তিন মামলায় একই ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে। শুধু বাদী, ঘটনাস্থল ও সময় আলাদা দেখানো হয়েছে। এজাহার ঘেঁটে দেখা যায়, তিনটি মামলায় রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয়েছে। তার ঠিকানা লেখা চান্দনা, বাসন। অন্য একটি মামলার বাদী চান্দনা পশ্চিমপাড়ার হোসেন মিয়ার ছেলে রাজিব হোসেন।
মোবাইল ফোনে আলাপকালে রাজিব হোসেন বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোনো মামলা করিনি। পুলিশ আমার নাম লিখলেই কি আমি বাদী হয়ে গেলাম। রবিনের বিরুদ্ধে এ ধরনের কোনো মামলা করেছি বলে আমার জানা নেই।’
মামলার নথিপত্র ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় খুন হন হামজা নামের এক ব্যক্তি। এ হত্যা মামলার এজাহারে আসামি তালিকার চার নম্বরে রবিনের নাম ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ। এ মামলার রায়ে আদালত রবিনসহ সব আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। এছাড়া ২০২১ সালের মার্চে এক তরুণীকে অপহরণের নাটক সাজিয়ে রবিনকে আসামি করে অপহরণ মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে বাদী বানানো হয় তরুণীর সহপাঠী আল মামুনকে। মামলার পর মামুন পুলিশি ভয়ে গাজীপুর ছেড়ে চলে যান। এজাহারে দেওয়া তার মোবাইল নম্বরও বন্ধ।
গত বছরের ২৭ এপ্রিল গাজীপুর সদর থানায় দায়ের করা একটি মামলার সূত্র ধরে যুগান্তরের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দ্রুত বিচার আইনে ওই মামলা নম্বর ৪৯। এজাহারে বাদী নিজেকে স্থানীয় বেন্টলি সোয়েটার লিমিটেডের ম্যানেজার হিসাবে পরিচয় দিয়ে উল্লেখ করেন, ‘এক নম্বর আসামি রবিন সরদারসহ অন্য আসামিরা সশস্ত্র অবস্থায় ফ্যাক্টরিতে গিয়ে তিন লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে গুলি করে হত্যার হুমকি দেয়। সশস্ত্র আসামিরা মোটরসাইকেলযোগে মহড়া দিয়ে ফ্যাক্টরির ভেতর প্রবেশ করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করে।’ মামলাটির তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে মর্মে রবিনসহ ৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা যায়, এ মামলার বাদীর পরিচয় ও ঠিকানা ভুয়া। বাদী মো. ফজলুল হক এজাহারে নিজেকে আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ-সদস্য ডা. এইচবিএম ইকবালের মালিকানাধীন বেন্টলি সোয়েটার ফ্যাক্টরির ম্যানেজার পরিচয় দিলেও তিনি প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তাকর্মী। পরিচয় গোপন করে রবিনকে সঙ্গে নিয়ে ফজলুল হকের মুখোমুখি হন এ প্রতিবেদক। আলাপকালে রবিনকে উদ্দেশ করে ফজলুল হক বলেন, ‘তোমার নামে হুদাই খালি মামলা দেওয়াইছে। তোমার কোনহানে জীবনে নাম আছে?’ এ সময় রবিন বলেন, আপনি বাদী না হলে পুলিশ কি মামলা দিতে পারত-জবাবে তিনি বলেন, ‘যে অবস্থা, মনে করো পুলিশ আমারে হাত পা বাইন্দা নইয়া (নিয়ে) যায়। কি করার আচে? আমি কি তোমার বিরুদ্ধে মামলায় গ্যাতাম (যাইতাম)। পুলিশ বাসা থেকে ধইরা নিয়া আমারে বাদী বানাইচে। এজাহারে যা বলচে আমাগো ফ্যাক্টরিতে এমন কোন ঘটনা অয় নাই।’
মামলাটির তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দেন গাজীপুর সদর থানার তখনকার সাব-ইনস্পেকটর তুহিন মিয়া। বর্তমানে তিনি কাশিমপুর থানায় কর্মরত। মোবাইল ফোনে কল করে তার কাছে প্রশ্ন ছিল-তৎকালীন ওসি রফিকুল ইসলামের সাজানো মামলার অভিযোগ সত্য বলে চার্জশিট দিলেন কীভাবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কোনো মামলার বিষয় আমার মনে পড়ছে না। মামলার নম্বর বললে নথিপত্র দেখে বলতে পারব।’ পরে তার মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে মামলার এজাহার ও চার্জশিটের কপি পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।