মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্ভিদ কীটতত্ত্ববিদরাই ভরসা
১৭ কোটি মানুষের জন্য মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ একজন
২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২৯৫৯ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে মৃত্যু ১২
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা নিধন গবেষণার প্রধান কাজ মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট বা কীটতত্ত্ববিদদের। তারা মশার লার্ভার উপযুক্ত জরিপ করে সঠিক ফলাফল জানাবেন।
সেই ভিত্তিতে কোথায় কী পরিমাণ মশার ঘনত্ব রয়েছে, তা নির্ণয় করে সরকারকে জানাবেন। ক্ষুদ্র প্রাণীটির বংশবিস্তার, সেরোটাইপ বা ধরন নির্ণয়সহ মশা নিধনের সঠিক পদ্ধতি ও রাসায়নিক প্রয়োগের কৌশল সম্পর্কেও তথ্য দেবেন।
কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের জন্য সরকারিভাবে মাত্র একজন মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট (কীটতত্ত্ববিদ) রয়েছেন। ফলে মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্ভিদ কীটতত্ত্ববিদ দিয়ে ঠেকার কাজ চালাতে হচ্ছে। বর্তমানে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস সংক্রমণে দেশের পুরো জনস্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকির মুখে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে দুই যুগ ধরে প্রাণঘাতী এডিস মশার প্রাদুর্ভাব চলছে। মাঝে কয়েক বছর পরিস্থিতি বেশি অবনিত হওয়ায় অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মারা গেছেন। অথচ মশা নিয়ন্ত্রণ গবেষণায় এখন পর্যন্ত মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ তৈরি করা সম্ভব হয়নি।
সরকারের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) একমাত্র মেডিকেল এন্টোমলজিস্ট হিসাবে কাজ করছেন অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার। নিপসমের কীটতত্ত্ব বিভাগের এই বিভাগীয় প্রধান কর্মকর্তা দেশের বাইরে থেকে মেডিকেল এন্টোমলজি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, মেডিকেল এন্টোমলজিস্টদের প্রধান কাজ মশার উপযুক্ত জরিপ করা।
কোথায় কী পরিমাণ মশার ঘনত্ব রয়েছে, সেটি নির্ণয় করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে সঠিক ফলাফল জানানো। সেই ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগে নিয়ে মশা নিধন কর্মসূচি চালাবে। মেডিকেল এন্টোমলজিস্টদের সহযোগিতা ছাড়া যদি অন্যরা মশা ও লার্ভা জরিপ করে আর সেটি যদি সঠিক না হয়, তাহলে সরকারের কাছে ভুল বার্ত যাবে। তখন মশা নিধনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া চ্যালেঞ্জ হবে। এক্ষেত্রে ফলাফল উলটো হতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের চিকিৎসা শিক্ষায় এমবিবিএস কোর্সে মেডিকেল এন্টোমলজি বিষয়ে পাঠ দেওয়া হয় না। নিপসমের কোর্স কারিকুলাম দেখভাল করে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট নিপসমের মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ) ও মাস্টার্স অব ফিলোসফি (এমফিল) কোর্সের একটি অংশে মেডিকেল এন্টোমলজি অধ্যায় যুক্ত করেছে।
তবে এমপিএইচ ইন মেডিকেল এন্টোমলজি বিষয়ে পৃথক ডিগ্রি বা সনদ দেওয়া হয় না। অথচ দেশে এই মুহূর্তে পাঁচটা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ফলে এমপিএইচ ইন মেডিকেল এন্টোমলজি, এমএস ইন মেডিকেল এন্টোমলজি ও অনার্স ইন মেডিকেল এন্টোমলজি বিষয়ে কোর্স কারিকুলাম তৈরি করে ডিগ্রি দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।
ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা পাঁচগুণ বেশি : ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েক হাজার হাসপাতালের মধ্যে কেবল ৬৩টি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য নেওয়া হয়। ডেঙ্গু নিয়ে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অন্তত পাঁচগুণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্যই পৃথিবীর জ্বর হয়েছে। সেই জ্বরে বাংলাদেশও আক্রান্ত।
২০১৯ সালের থেকে ২০২৩ সালে ভয়াবহভাবে ডেঙ্গু বিস্তার লাভ করেছে। মশাসহ বিভিন্ন কীটপতঙ্গবাহী রোগের প্রকোপে আক্রান্ত ও মৃত্যু আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর নিপসম মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জ : করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা বলা হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা।
তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় তিনি রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সিডিসির লাইন ডিরেক্টর ছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেসময় তাদের ঘুম হারাম হয়েছিল। এবার পরিস্থিতি সে সময়ের চেয়ে খারাপ হচ্ছে। ২০১৯ সালে সারা বছরে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। এবার আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি। বাকি দিনগুলোয় আমরা মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে পারব, এমন হবে না। মৃতের এই সংখ্যা দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে।
ডা. তহমিনা বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে জরিপ, তথ্য সংগ্রহ, নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েক হাজার হাসপাতালের মধ্যে ৬৩টি হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গুর তথ্য নেওয়া হয়। সুতরাং আমরা বুঝতে পারছি, ডেঙ্গু আক্রান্ত এবং মৃত্যু দুটোই অনেক (প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে) কম।
দ্বিতীয় প্রবন্ধ উপস্থাপনায় অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার উল্লেখ করেন, মশা নিধনে উপর্যুপরি কীটনাশকের ব্যবহার প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এমনকি মশা প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। যা মানুষসহ অন্যান্য জীবের ওপরও বিষক্রিয়া সৃষ্টি করছে। ফলে তিনি সমন্বিত বাহক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, দেশের স্বাস্থ্য খাতে মেডিকেল এন্টোমলজিস্টের জায়গা খুব ছোট। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিপসমে মেডিকেল এন্টোমলজিস্টের কাজের সামান্য সুযোগ আছে।
কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি বা যোগ্যতা অর্জন করে এই পেশায় আসা যাবে, এখন পর্যন্ত মেডিকেল এন্টোমলজির সেই জায়গা তৈরি হয়নি। এন্টোমলজি ও এন্টোটেকনেশিয়ান মিলিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখায় ২০ জনের মতো কাজ করছেন। যাদের অনেককেই বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা থেকে প্রেষণ নিয়ে আসা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কাজ করছে। ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে লোকবল তৈরির কাজ চলছে। সেখানে মেডিকেল এন্টোমলজিস্টদের জন্য পদ তৈরি করা হচ্ছে। পদসোপান রাখা হচ্ছে।
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে সময় লাগলেও সেটা অসম্ভব নয়। মশা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এখন আক্রান্ত রোগীকে যেন মশা না কামড়ায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এখন প্রতিটি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে মশারির ভেতর রাখা নিশ্চিত করা দরকার। যেমন কোভিডের সময় প্রতিটি আক্রান্ত মানুষকে মাস্ক পরতে বলা হয়েছিল। মশারির ভেতরে থাকলে এডিস মশা কামড়ানোর মতো লোক পাবে না। রোগীকে কামড়াতে না পারলে সে ডেঙ্গুও ছড়াতে পারবে না। প্রতিটি আক্রান্ত রোগীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্তদের বেডরেস্ট এবং চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।
সেমিনারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করা, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা কৌশল ঠিক করা, মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা, বিভিন্ন এলাকায় মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে মশারি বিতরণের উদ্যোগ নেওয়াসহ দশটি সুপারিশ করে পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করব, যেন এনজিও, প্রাইভেট সেক্টরকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কাজে যুক্ত করা হয়। হাসপাতালের ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি জরুরি ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি ৫ বছর, ১০ দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করব।
একদিনে রেকর্ড ২৯৫৯ রোগী হাসপাতালে, মৃত্যু ১২ : এদিকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতার মধ্যে সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় সর্বাধিক ২ হাজার ৯৫৯ জন ভর্তি রোগী দেখল বাংলাদেশ। এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে আরও ১২ জনের। বুধবার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে এসব রোগী ভর্তি হন। এর মধ্য দিয়ে আগের দিন বুধবার ২ হাজার ৮৪৪ জন রোগী ভর্তি হয়ে যে রেকর্ড তৈরি হয়েছিল, তা ভাঙল। নতুন রোগীদের নিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ২৮ জনে।
এর মধ্যে আগস্টের প্রথম ৯ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন ২৬ হাজার ১৯৬ জন। একদিনে যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে, এর মধ্যে ৭ জনই ঢাকার, বাকিরা বাইরের। সবমিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৩৬৪ জন দাঁড়িয়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ৯ হাজার ৭৯০ জন রোগীর চিকিৎসা চলছিল। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৪ হাজার ৪৬০ জন এবং ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় ৫ হাজার ৩৩০ জন।
এ বছর জুলাইয়ের ৩১ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৩ হাজার ৮৫৪ জন রোগী, মৃত্যু হয় ২০৪ জনের। এক মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর এই সংখ্যা এ বছরের মোট সংখ্যার অর্ধেকের বেশি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এ বছর যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন এবং শক সিনড্রোমে মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডেঙ্গু যে শুধু স্বাস্থ্য বিভাগের একার সমস্যা নয়, সবার সমস্যা ধরে নিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে সমন্বিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য মেডিকেল এন্টোমলজিস্টও তৈরি করতে হবে।