হতাশ বরিশালের নেতাকর্মীরা
সুযোগ পেয়েও নেত্রীকে বললেন না কেউ কিছু
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল
প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
মুখ খুললেন না কেউ। বললেন না মাঠের সত্যিকার পরিস্থিতি। অথচ তাদের প্রতি ছিল তৃণমূলের আশা। দলীয় সভানেত্রীর কাছে বলবেন সব-এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা পূরণ হয়নি। মুখ ফুটে কেউ কিছু বলেননি নেত্রীকে। বলেননি বরিশালে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বে দলের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা। মনোনয়নের লড়াইয়ে লিপ্ত নেতারা যে জেলায় জেলায় বারোটা বাজাচ্ছেন দলের তাও বলেননি কেউ।
বরং বললেন নিজেদের স্বার্থের কথা। আদায় করে নিলেন ভারমুক্ত হওয়ার সনদ। রোববার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় বরিশালের নেতাদের দেওয়া বক্তব্য নিয়ে তাই হতাশ মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। অবশ্য তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না, এমনটাও বলছেন তারা। এমপি-মন্ত্রীদের গড়া কমিটির নেতারা তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না, এটাই স্বাভাবিক মন্তব্য তাদের।
গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভা নিয়ে তুমুল আগ্রহ ছিল নেতাকর্মীদের। দীর্ঘদিন পর দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডেকেছেন জেনে আশার জাল বুনছিল সবাই। সভায় যোগ দিতে যাওয়া নেতারা মাঠ পর্যায়ের সত্যিকার চিত্র তুলে ধরবেন সেই আশা ছিল সবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেত্রীর সামনে তেমন কিছুই বলেননি কেউ। বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেয়েও এড়িয়ে যান সবাই। দলীয় সভানেত্রী নিজেই এখানকার চার নেতাকে বক্তৃতার সুযোগ দেন। তারা হলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস, পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা কাজী আলমগীর,
পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল এবং বরগুনার তালতলি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান রেজভি উল কবির জমাদ্দার। তাদের মধ্যে মাঠের পরিস্থিতি সম্পর্কে কাজী আলমগীরের বক্তব্যে বাস্তবতা উঠে এলেও অন্যরা বলেননি কিছুই। বলেননি দক্ষিণের জেলায় জেলায় দলের অভ্যন্তরে চলমান অন্তর্দ্বন্দ্ব, কোন্দলের কথা। যেসব নেতার কারণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে তাদের ব্যাপারেও মুখ খোলেননি কেউ। এ নিয়েই হতাশায় মাঠের কর্মীরা।
গত ১৫ এপ্রিল ঘোষিত হয় বরিশাল সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন। বর্তমান সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর স্থলে মনোনয়ন পান তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাত। এরপর থেকেই অস্থিরতা ভর করে বরিশাল আওয়ামী লীগে।
সাদিক আর খোকন শিবিরে বিভক্ত হয় দল। নির্বাচনের পুরোটা সময় বিরাজমান অস্থিরতা চলছে এখনো। চাচা-ভাতিজার মিলন তো দূরের কথা, বাড়ছে জটিলতা। দখল বেদখলের পাশাপাশি চলছে দলীয় কর্মসূচি পালনের পালটা-পালটি লড়াই। সভানেত্রীর সামনে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পেলেও বরিশালে বিরাজমান এই সমস্যার ব্যাপারে কিছুই বলেননি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. তালুকদার মো. ইউনুস। বরং তিনি বলেছেন এখানে দলের সবাই ঐক্যবদ্ধ।
বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে অ্যাড. ইউনুস বলেন, আমি জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষে বক্তব্য রেখেছি। জেলা আওয়ামী লীগে কোনো বিভক্তি নেই। তা ছাড়া কোনা কিছুই নেত্রীর অজানা নয়। আমি বলেছি দলের প্রতি আমার আনুগত্যের কথা। নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন তার পক্ষে নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করব তাই।
বিগত জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল। মনোনয়ন পেয়ে এমপি হলে মন্ত্রী করা হয় অ্যাড. শ ম রেজাউল করিমকে। তারপর থেকেই রেজাউল-আউয়াল দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ। নির্বাচনি এলাকায় কমিটি গঠন নিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষ-গুলি পর্যন্ত হয়েছে। কেন্দ্র থেকে অনুমোদিত জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি নিয়েও রয়েছে অভিযোগ।
কমিটির সিংহভাগ সাবেক এমপি আউয়াল পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন বলে লিখিত অভিযোগ গেছে কেন্দ্রে। দুই নেতার দ্বন্দ্বে যেখানে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ সেখানে দলীয় সভানেত্রীর সামনে দেওয়া বক্তব্যে মাঠের এসব কিছুই বলেননি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কানাই লাল। জ্বালাময়ী বক্তব্যের পুরোটা জুড়ে ছিল যেন জাতীয় রাজনীতির ছোঁয়া। সর্বশেষ তিনি সভানেত্রীর কাছে আবেদন জানান তাকে ‘ভারমুক্ত’ করার। আবেদনে সাড়া দিয়ে কেবল কানাই লালই নন, সারা দেশে যতজন ভারপ্রাপ্ত আছেন তাদের সবাইকে ভারমুক্ত করার ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা।
এভাবে নিজেরটুকু আদায় করে নিলেও নিজ জেলার বিষয়ে তার নীরবতায় ক্ষুব্ধ দলীয় কর্মীরা। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, আউয়াল-রেজাউলকে এক জায়গায় বসিয়ে জটিলতা নিরসন খুব একটা কঠিন নয়। দলের স্বার্থে সেটা বলতে পারতেন কানাই লাল। কিন্তু তিনি তা এড়িয়ে গেলেন। কেননা সাবেক এমপি আউয়ালের আস্থাভাজন হওয়ার কারণেই ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তাই হয়তো চাননি আউয়ালকে ক্ষেপাতে।
বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলার জন্য কানাই লালের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ধরেননি তিনি।
বরিশাল এবং পিরোজপুরের মতোই সভানেত্রীর সামনে দেওয়া বক্তব্যে নিজ জেলা বরগুনায় দলের চলমান পরিস্থিতি প্রশ্নে কিছুই বলেননি তালতলি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজভি উল কবির জমাদ্দার। সেখানকার দুই এমপিকে নিয়ে দলে চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথা না বললেও একটি ইতিবাচক বিষয় অবশ্য তুলে ধরেন রেজভি। ৩টি নির্বাচনি এলাকার জেলা বরগুনাকে দুটি নির্বাচনি এলাকায় পরিণত করার ঘটনায় ক্ষোভ জানান তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বরগুনার একটি আসন কেটে নেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, যে আসনে নির্বাচন করে আপনি (শেখ হাসিনা) এমপি হয়েছিলেন সেটিকেই বিলুপ্ত করা হয়েছে। নির্বাচনি এলাকা সংকুচিত হওয়ায় উন্নয়ন বরাদ্দ যেমন কমেছে তেমনি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন। তা ছাড়া বিশাল একটি নদী মাঝখানে রেখে আসন বিভাজন কোনোক্রমেই যুক্তিযুক্ত নয়।
বরগুনার নির্বাচনি এলাকা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান রেজভি। পাশাপাশি আহ্বান জানান আমতলী উপজেলা কমিটি নিয়ে বিরাজমান জটিলতা নিরসনের। যুগান্তরকে এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আমি জেলা আওয়ামী লীগের অন্তর্গত একটি ইউনিটের সভাপতি। জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলার এখতিয়ার আমার নেই। তাই আমি কেবল আমার এলাকার কথাই বলেছি।
দক্ষিণের নেতাদের মধ্যে একমাত্র কাজী আলমগীর তুলে ধরেন তার জেলার সঠিক চিত্র। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলের এমপিদের দূরত্ব থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ে কথা বলেন তিনি। বলেন কীভাবে নেতারা মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অবমূল্যায়ন করেন তা। বাউফল উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপের মুখে পড়ার কথাও বলেন তিনি।
বর্ধিত সভায় দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, আজন্ম আওয়ামী লীগ করা আমি দলের কিসে ভালো আর কিসে মন্দ হবে তা বলব, এটাই স্বাভাবিক। বাউফলে বর্তমান এমপি আ.স.ম ফিরোজ ও পৌর মেয়র জিয়াউল হক জুয়েলের দ্বন্দ্বে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দল। আমরা আজ পর্যন্ত ওই উপজেলার কমিটি অনুমোদন দিতে পারিনি। মাঠের কর্মীরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে এমপি বানায়।
এমপি হওয়ার পর তারা আর তাদের মনে রাখে না। দলের প্রতি ডেডিকেশনের চেয়ে নিজের অনুগত দল তৈরি করার দিকে বেশি মনোযোগী হন সংসদ-সদস্যরা। এসব তো দলের ক্ষতি করছে। আমরা এই চর্চা থেকে বেরোতে চাই। বর্ধিত সভায়ও তাই বলেছি।