ভিকারুননিসার ছাত্রীসহ মৃত্যু ১৪
পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না হাসপাতাল
২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২৬৫৩ রোগী ভর্তি : এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে দৌড়াতে গিয়ে রোগীর করুণ দশা * অনেক হাসপাতালে ১১টার পর মিলছে না পরীক্ষার টিকিট
জাহিদ হাসান
প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
যেন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল। গাণিতিক হারে বেড়ে চলা রোগটির ঊর্ধ্বমুখী ধারায় সবশেষ ২৪ ঘণ্টায় আরও ২,৬৫৩ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। একদিনের ব্যবধানে এবার ডেঙ্গু কেড়ে নিল রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও এক ছাত্রীসহ ১৪ জনের জীবন। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকার ১০ জন এবং ঢাকার বাইরের ৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার ১৭২ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৩ জন মারা যান।
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হতে গিয়ে হয়রানিতে পড়ছেন। শয্যা সংকটে রোগীর ঠাঁই মিলছে না অনেক হাসপাতালে। রোগী ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানানোয় বুধবার মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসক ও অভিভাবকদের মধ্যে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। অনেক হাসপাতাল নির্ধারিত শয্যার বাইরে মেঝে ও বারান্দায় রোগী ভর্তি করে চিকিৎসা চলছে।পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে স্বাস্থ্য বিভাগ ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীদের অকারণে ঢাকায় না পাঠিয়ে স্থানীয় হাসাপতালগুলোতে চিকিৎসা দিতে সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশ দিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনা নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ডেঙ্গু রোগীদের স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিতের নির্দেশ দেন। প্রয়োজনে ছাড়া ঢাকায় যেনো ডেঙ্গু রোগী পাঠানো না হয়, সে বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জনদের নির্দেশ দেওয়া হয়। জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক কবীর বলেন, ডেঙ্গু রোগী সামলানোর দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের হলেও মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ তাদের নয়। এটি স্থানীয় সরকার বিভাগের। যে করেই হোক, মশক নিধন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। মানুষকে এই মহামারির হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রাশেদা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, মুগদাসহ কয়েকটি হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে দুই হাজার ৬৫৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ৩২৭ জন এবং সারাদেশে (ঢাকা ব্যতীত) এক হাজার ৩২৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে মোট ২ হাজার ৩৭৭ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ২০৩ জন। অন্যদিকে সারাদেশের (ঢাকা ব্যতীত) বিভিন্ন হাসপাতালে থেকে এক হাজার ৭৪ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন।
প্রাপ্ত হিসাব মতে, চলতি বছরের ২৬ জুলাই পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ৩৪১ জন। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ২৩ হাজার ৬৭৬ জন ও সারাদেশে (ঢাকা সিটি ব্যতীত) ১৬ হাজার ৬৬৫ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। চলতি বছরের গতকাল পর্যন্ত মোট ৩১ হাজার ৯৩৭ জন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। বর্তমানে সারাদেশে মোট আট হাজার ১৮৯ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে রয়েছেন ঢাকায় চার হাজার ৭৬০ জন এবং সারাদেশে (ঢাকা ব্যতীত) তিন হাজার ৪২৯ জন।
গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে ৭৭ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ১২৩ জন, মুগদা হাসপাতালে ১৪১ জন, কুর্মিটোলা জেনারেলে ৮৪ এবং ডিএনসিসি কোভিডি হাসপাতালে ১০২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এছাড়া বিভাগীয় শহরের মধ্যে ঢাকা শহর ব্যতীত গত ২৪ ঘণ্টায় এই বিভাগে ভর্তি হয়েছেন ৩১৯ জন, ময়মনসিংহে ৯৩ জন, চট্টগ্রামে ৩৩৬ জন, খুলনায় ১০৩ জন, রাজশাহীতে ৮৪ জন, রংপুরে ৭৯ জন, বরিশালে ২৮৪ জন এবং সিলেটে ২৮ জন ভর্তি হয়েছেন।
বুধবার সকাল ৯টায় ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গযুক্ত ছোটবোন রুনা লায়লাকে (২৮) কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে আসেন উত্তরার বাসিন্দা আপেল মাহমুদ। দীর্ঘ দুই ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি বহির্বিভাগের টিকিট কাটতে পারেননি। অবশেষে পরিচিত হাসপাতালের এক নার্সের মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করেন। এরপর একজন গণমাধ্যমকর্মী ও হাসপাতাল তত্ত্বাবধায়কের সহায়তায় বোনকে চিকিৎসক দেখাতে সক্ষম হন।
ওই হাসপাতালের একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে জানান, আড়াই শয্যার হাসপাতালটির বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগে দৈনিক গড়ে দেড় হাজার রোগী আসছে। যাদের অধিকাশই ডেঙ্গু রোগী। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্তদের জন্য পৃথক কর্নার খোলা হয়েছে। কিন্তু শয্যা অনুপাতে ডেঙ্গু রোগী বেশি হওয়ায় মেডিসিন, গাইনি, সার্জারি ও পেডিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ভর্তি করা হচ্ছে। রোগীর চাপে সকাল ১১টার পর রোগ শনাক্ত টিকিট দেওয়া হচ্ছে না। দুপুর ১২টার পর বহির্বিভাগের টিকিটও দেওয়া হয় না। এতে প্রতিদিন ভর্তিযোগ্য অনেক রোগী ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
ডেঙ্গুতে প্রাণ গেল ভিকারুননিসার এক ছাত্রীর : এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। তার নাম সেতারা রহমান প্রিয়াঙ্কা। সে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিবা (মূল, বাংলা ভার্সন) শাখার তৃতীয় শ্রেণির (ঘ-শাখা, রোল-৫৯) শিক্ষার্থী ছিল। মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী এ তথ্য জানিয়েছেন। জানা যায় ‘প্রথমে ওই শিক্ষার্থীর মা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। মায়ের অবস্থা এখন বেশ ভালো। পরে মেয়েটাও আক্রান্ত হয়। ৪ থেকে ৫ দিন ধরে অসুস্থ ছিল। পরিবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। সেখানে মঙ্গলবার রাতে মারা গেছে।
ছাত্রীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বলেন, তার মৃত্যুতে ভিকারুননিসা পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। এর আগে গত ৩ জুলাই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভিকারুননিসার মূল শাখার একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী ইলমা জাহান মারা যায়। সে প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল।
সরকারের রোগতত্ত্ব রোগী নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন, যুগান্তরকে বলেন, দেশে এখন ডেঙ্গুর মহামারি পরিস্থিতি চলছে। ডেঙ্গু ছড়ানোর জন্য দায়ী এডিস মশা মোকাবিলায় জরুরি ভিত্তিতে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, যেসব জায়গায় ডেঙ্গু হচ্ছে সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র তৈরি করতে হবে। যেখানে সন্দেভাজন রোগীরা বিনামূল্যে জ্বরের পরীক্ষা করাতে পারবেন। পরীক্ষায় যাদের ডেঙ্গু শনাক্ত হবে। কিন্তু বিপদের চিহ্ন নেই তাদের সরাসরি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া যাবে না। যদি তারা বাড়ি গিয়ে মশারির নিচে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবে, তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের নজরদারি নিশ্চিত করে বাড়ি পাঠানো যেতে পারে। বাকিদের প্রাথমিক বা মাধ্যমিক হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।