বিশ্বখাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন
তিন বিভাগে খাদ্যের খরচ বেশি
হামিদ-উজ-জামান
প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশের আট বিভাগের মধ্যে তিনটিতে প্রতি মাসে মানুষের মাথাপিছু গড়ে খাদ্য উপকরণ কেনার খরচ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। বিভাগগুলো হলো-চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে গড়ে মাথাপিছু খাদ্য উপকরণের দাম বাড়া ও কমার মিশ্র প্রবণতা রয়েছে। রংপুর ও খুলনা বিভাগে খাদ্য কেনার খরচ কিছুটা কমেছে। তবে রাজশাহী বিভাগে খরচ সবচেয়ে বেশি কমেছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এপ্রিলে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তা বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও কক্সবাজার জেলার কয়েকটি উপজেলার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এক মাসে মানুষ মাথাপিছু গড়ে কী পরিমাণ খাদ্য উপকরণ ক্রয় করে তার দামের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে। প্রতি মাসে মানুষের কী পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তার আলোকে ‘ন্যাশনাল কস্ট অব ফুড বাস্কেট বা জাতীয় খাদ্য ঝুড়ির খরচ’ শীর্ষক নীতিমালা রয়েছে। ওই নীতিমালায় খাদ্যের পরিমাণ ও বিভিন্ন বিভাগে ওই পরিমাণ খাদ্যের দামের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় খাদ্য ঝুড়িতে মাসে একজন মানুষের গড়ে সাত হাজার ২০০ গ্রাম চাল, ৯০০ গ্রাম আটা, দেড় হাজার গ্রাম আলু, ৯০০ গ্রাম ডাল, সাড়ে চার হাজার গ্রাম শাক, ৯ হাজার গ্রাম সবজির প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া ফল তিন হাজার গ্রাম, মাছ তিন হাজার গ্রাম, ডিম এক হাজার ৮০০ গ্রাম, দুধ সাড়ে চার হাজার গ্রাম, চিনি ১৫০ গ্রাম, রান্নার তেল ৪৫০ গ্রাম ও মসলা ৬০০ গ্রাম প্রয়োজন।
প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, এসব খাদ্য উপকরণ কিনতে মার্চের তুলনায় এপ্রিলে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে গড়ে খরচ বেড়েছে ১ দশমিক ০৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের গড়ে কিছু অঞ্চলে কমেছে, আবার কিছু অঞ্চলে বেড়েছে। এ হিসাবে বিভাগ দুটিতে গড়ে কোথাও দশমিক ৭৮ শতাংশ কমেছে। আবার কোথাও গড়ে ১ দশমিক ০৪ শতাংশ বেড়েছে। রংপুর ও খুলনা বিভাগে মাথাপিছু গড়ে খাদ্য উপকরণ কেনার খরচ কমেছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ থেকে দশমিক ৭৯ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে গড়ে মাথাপিছু খাদ্য উপকরণ কেনার খরচ কমেছে ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।
সূত্র জানায়, প্রচলিত নিয়মে বড় শহরে খাদ্যের দাম বেশি বাড়ার কথা। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগ অন্যতম। কারণ এ বিভাগেই বড় বড় শহর রয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ। এসব এলাকা শিল্পসমৃদ্ধ। কিন্তু এখানে দাম বেশি না বেড়ে বেড়েছে গ্রামসমৃদ্ধ বিভাগগুলোতে। চট্টগ্রাম বিভাগে বৃদ্ধির কিছুটা যুক্তি থাকলেও বরিশাল ও সিলেট বিভাগে দাম বেশি বাড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এখন আর গ্রাম শহর কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। গ্রামে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় সেগুলোর দামের পার্থক্য আগে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বেশি ছিল। কিন্তু এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবহণ সহজ হওয়াসহ নানা কারণে শহরে যে দাম থাকে গ্রামেও একই দাম। কোনো ক্ষেত্রে গ্রামে বেশি থাকে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এখন ফোনেই সারা দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পণ্যের দামের ক্ষেত্রে এক ধরনের মনোপলি ব্যবস্থা সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে তেল, আটা, চিনিসহ যেসব পণ্য বিভিন্ন কোম্পানি বাজারজাত করছে তারা যদি গাজীপুরে উৎপাদন করে তাহলে দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সারা দেশের পরিবহণ খরচসহ সব মিলিয়ে একই রেট দেয়। এমন নয় যে, গাজীপুরে উৎপাদন হলো বলে সেখানে পরিবহণ খরচ শূন্য হওয়ায় দাম কম হওয়ার কথা। সেটি তো হচ্ছে না। আবার কোনো ক্ষেত্রে শহর থেকে যেসব পণ্য গ্রামে যায় সেগুলো দাম বেশি ধরে বিক্রি করা হয়। ফলে কোনো ক্ষেত্রে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, মার্চের তুলনায় এপ্রিলে এক মাসের গড় হিসাবে বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমেছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে ছয় মাসের হিসাবে কিছু পণ্যের দাম যেমন কমেছে, তেমনি বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে এক বছরের হিসাবে সব পণ্যের দামই বেড়েছে।
প্রতিবেদনে চাল, আটা, পামওয়েল, মসুর ডাল, আলু, সয়াবিন তেল, ফার্মের মুরগি, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, চিনি, কাঁচামরিচ, লবণ, এলপিজি গ্যাস, তেলাপিয়া মাছ, পেঁপে ও কলা ইত্যাদি পণ্যের দাম উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মার্চের তুলনায় এপ্রিলে সিলেটে চালের দাম বেড়েছে। ছয় মাস ও এক বছরের হিসাবেও এ বিভাগে চালের দাম বেড়েছে। এক মাসের হিসাবে বাকি সব বিভাগেই সামান্য কমেছে।
ছয় মাসের হিসাবে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে গড়ে চালের দাম কমেছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ হারে। এছাড়া বাকি সব বিভাগে বেড়েছে। এক বছরের হিসাবে সব বিভাগেই চালের দাম গড়ে বেড়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকায় চালের দাম ৭ দশমিক ৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, বরিশালে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, খুলনায় ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, সিলেটে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ, রংপুরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
আটার দাম এক মাসের হিসাবে সব বিভাগেই কমেছে। ছয় মাস ও এক বছরের হিসাবে সব বিভাগেই এর দাম বেড়েছে। এর মধ্যে ছয় মাসের হিসাবে গড়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ ও এক বছরের হিসাবে গড়ে ৫৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। এক বছরে আটার দাম ঢাকায় ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৬২ দশমিক ৯ শতাংশ, বরিশালে ৬০ দশমিক ১ শতাংশ, খুলনায় ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ, সিলেটে ৪৮ দশমিক ২ শতাংশ ও রংপুরে ৫৮ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। আলুর দাম এক মাসে বেড়েছে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। বরিশাল ও খুলনায় এক মাসে আলুর দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ করে। এক বছরের হিসাবে বেড়েছে ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ, খুলনাতে ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪৯ শতাংশ, সিলেটে ৪৬ শতাংশ, রংপুরে ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে।
সয়াবিন তেলের দাম এক মাসে কমেছে ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ, রাজশাহীতে দশমিক ১ শতাংশ, বরিশালে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, খুলনায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, সিলেটে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে।
ব্রয়লার মুরগির দাম সব বিভাগেই এক মাসে কমেছে গড়ে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ। ঢাকায় ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ, বরিশালে ৩১ শতাংশ, খুলনা ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ, সিলেটে ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুরে ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে।
ডিমের দাম সব বিভাগেই এক মাসে কমেছে ২ দশমিক ১ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকায় ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৭ দশমিক ১ শতাংশ, বরিশালে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, খুলনায় ২৬ দশমিক ২ শতাংশ, চট্টগ্রামে ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ, সিলেটে ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুরে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে।
পেঁয়াজের দাম এক মাসে খুলনা বিভাগে কমেছে, বাকি সব বিভাগে বেড়েছে। গড়ে সব বিভাগেই বেড়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে ঢাকায় ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ, বরিশালে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, খুলনায় ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ, সিলেটে ৩৯ দশমিক ১ শতাংশ, রংপুরে ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে।
চিনির দাম সব বিভাগেই বেড়েছে। এর মধ্যে এক মাসে ২ দশমিক ৮ শতাংশ ও এক বছরে ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকায় ৪৯ শতাংশ, রাজশাহীতে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ, বরিশালে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ, খুলনায় ৪৭ দশমিক ১ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ, সিলেটে ৪৭ দশমিক ৩ শতাংশ, রংপুরে ৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে।
দামের এ বৈষম্য প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গ্রামে খাদ্যপণ্যের দাম শহরের তুলনায় কিছুটা কম থাকলেও মূল্যস্ফীতির হার বেশি। তবে কেন গ্রামে মূল্যস্ফীতির হার বেশি সেটি নিয়ে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। ভরা মৌসুমেও দেখা যায়, চালের দাম বেশি থাকে। এটাকে চাহিদা কিংবা যোগাযোগ কোনো দিক দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সরবরাহ ব্যবস্থার সমস্যা, প্রতিযোগিতার অভাব ইত্যাদি। কেননা বাজার ব্যবস্থায় আড়তদার, পাইকারসহ বিভিন্ন শ্রেণি আছে। বাজারের ওপর তাদের যে ভূমিকা, সেটির প্রভাবে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। গ্রামের বাজারে অতি মুনাফার যে সুযোগ তার পরিপূর্ণ ব্যবহারের পাশাপাশি আরও সুযোগ সৃষ্টি করেন ব্যবসায়ীরা। ফলে গ্রামে পণ্যের দাম বেশি হচ্ছে।
সিলেট চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে পণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসাবে সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটে পণ্যের উৎপাদন কম, রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি। ফলে এখানে টাকার প্রবাহ বেশি। বাইরে থেকে এখানে পণ্য আসতে খরচ বেড়ে যায়। এসব কারণে এখানে খাবার খরচ বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় হওয়ায় এখানে শিল্প কারখানা যেমন বেশি, তেমনি কর্মসংস্থানও বেশি। যে কারণে টাকার প্রবাহ বেশি। এ বিভাগের কক্সবাজার পর্যটন এলাকা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের কারণে দেশি বিদেশি কর্মীদের যাতায়াত বেশি। এসব কারণে চট্টগ্রাম বিভাগে খাদ্যের দাম এবং কক্সবাজারে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর বরিশাল বিভাগ থেকে উৎপাদিত পণ্য বাইরে চলে যাচ্ছে বেশি। ফলে স্থানীয়ভাবে দাম বাড়ছে। এছাড়া পর্যটকদের আগমনও বেড়েছে। এসব মিলে এ বিভাগে খাবার খরচ বেশি।
এদিকে ঢাকায় চার দিক থেকে পণ্যের জোগান বেশি। যে কারণে কিছু খাতে দাম কম থাকে। ময়মনসিংহে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম। যে কারণে এই দুই বিভাগে মিশ্র প্রবণতা।
রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগে খাবারের খরচ কমেছে। এসব বিভাগে শিল্প কারখানা নেই। ফলে মানুষের আয়ও কম। এতে চাহিদাও কম। ফলে খরচ কম হচ্ছে।