চাপ কমবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে
খাদ্যশস্য আমদানি কমিয়ে সাশ্রয় ৩০ কোটি ডলার!
চলতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আমদানি হবে ২৫ শতাংশ কম * অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ বাড়বে প্রায় ১৬ শতাংশ
মিজান চৌধুরী
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে খাদ্যশস্য আমদানি কমাচ্ছে সরকার। এজন্য আগামী (২০২৩-২৪) অর্থবছরে ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল ও গম কম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কমপক্ষে ৩১ কোটি মার্কিন ডলার (৩২৮০ কোটি টাকা) সরকারের সাশ্রয় হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।
তবে চাহিদা পূরণে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করা হবে। এজন্য কৃষককে চালের উপযুক্ত মূল্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পহেলা জুলাই থেকে পর্যায়ক্রমে এসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, আমন ও বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হয়েছে। এরপরও খাদ্যশস্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে তা আগামী সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো যাবে। এছাড়া অন্যান্য বছর কষ্ট করতে হলেও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের ক্ষেত্রে এ বছর কষ্ট করতে হচ্ছে না। কারণ আমাদের অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের পরিস্থিতি ভালো।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরের থেকে ২৫ শতাংশ কমিয়ে আগামী অর্থবছরে খাদ্যশস্য আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সে হিসাবে খাদ্য আমদানি খাতে চলতি অর্থবছরে ৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা থেকে বরাদ্দ কমিয়ে আগামী বাজেটে ৪ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দ কমছে ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা বা ৩০ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি (প্রতি ডলার মূল্য ১০৮.৭০ টাকা)।
প্রসঙ্গত খাদ্যশস্য আমদানি খাতে টাকায় বরাদ্দ রাখা হলেও দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে মূল্য পরিশোধ করা হয় মার্কিন ডলারে। সেটি সরকার টু সরকার বা বেসিরকারি পর্যায়ে আমদানির ক্ষেত্রে ডলারের মূল্য শোধ দিতে হয়।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি অর্থবছরে ডলারের মূল্য ৮০ টাকা ধরে খাদ্যশস্য আমদানির ব্যয় নিরূপণ করা হয়েছিল। ওই হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। কিন্তু গত বছরের জুন থেকে মার্কিন ডলারের মূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে টাকার মূল্যের অবনতি ঘটে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট দেখা দেয়। দেশ যেন এই সংকটের মুখে না পড়ে, সেজন্য প্রধানমন্ত্রী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি খাদ্যশস্য আমদানির নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে বিদ্যমান সংকট ও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়নে খাদ্যশস্য আমদানি ব্যয় ২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি পায় ৫ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা বা ৫২ কোটি ৪২ লাখ মার্কিন ডলার।
সূত্র মতে, আগামী অর্থবছরে ডলার সাশ্রয় করতে চলতি অর্থবছরের চাল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ মেট্রিক টন থেকে নামিয়ে ৪ লাখ টন করেছে সরকার। একইভাবে ৭ লাখ মেট্রিক টন গম আমদানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৬ লাখ টন কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে চলতি অর্থবছরে চাল ও গম মিলে মোট ১৬ লাখ টন আমদানি থেকে কমিয়ে আগামী অর্থবছর ১১ লাখ টন কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে।
অপরদিকে আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারে নিতে হবে। ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে খাদ্যশস্য আমদানিতে ডলার ব্যবহার কম করা হবে। যে কারণে চাল ও গম আমদানিতে বরাদ্দও কমানো হয়েছে। ১৪ জুন পর্যন্ত ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন চাল এবং ৩৪ লাখ ৪০ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে।
এদিকে আগামী অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন থেকে বাড়িয়ে চাল কেনা হবে ১৯ লাখ ৬১ হাজার মেট্রিক টন। আর গম কিনবে এক লাখ মেট্রিক টন। অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে চাল ও গম কেনার জন্য আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ১০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৭ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশ না করার মর্তে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, খাদ্যশস্য সংগ্রহে এক ধরনের ব্যালেন্স করা হয়। যেমন: চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে কম কেনাকাটা করা হয়েছে। কিন্তু খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ ছিল বেশি। আবার আগামী অর্থবছরে আমদানি কমানো হলেও অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সংগ্রহ বেশি পরিমাণ করা হবে। তবে কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য পান, এজন্য প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪৪ টাকা ধরা হয়। তিনি আরও বলেন, কৃষক মূল্য কম পেলে সরকারকে ধান ও চাল দিতে আগ্রহবোধ করবে না।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৪ জুন পর্যন্ত চাল আমদানি হয়েছে ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন এবং গম ৩৪ লাখ ৪০ হাজার টন। একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যায় থেকে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৭৫ মেট্রিক টন চাল এবং ৮৬ হাজার ৩৮৫ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। সাধারণত সরকার চাল ও গম সংগ্রহ করে সামাজিক নিরাপত্তার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তা বিতরণ করে। সেখানে দেখা গেছে, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাল ও গম বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে। চলতি অর্থবছরে চাল ও গম মিলে ২ হাজার ৩ মেট্রিক টন বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কমিয়ে আগামী অর্থবছরের জন্য ১ হাজার ৯২৩ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে।