পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী
দুর্নীতি অসদাচরণ দুর্ব্যবহার পাউবো কর্মকর্তার ‘অলংকার’
তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলেও পেয়েছেন পদোন্নতি
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কথায় বলে ‘ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. কোহিনুর আলমের ক্ষেত্রে এই প্রবচন যেন শতভাগ যথাযথ। দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি সব কর্মস্থলে তার বিরুদ্ধে ওঠা গুরুতর অভিযোগের একটি হলো-অসদাচরণ। বিভিন্ন মহলের আরও অভিযোগ, কোহিনুর আলম একজন দুর্বিনীত কর্মকর্তা। ঠিকাদারদের সঙ্গে যেমন উদ্ধত আচরণ করেন, তেমনি অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও করেন দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণ। কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ পাউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অজানা নয়। অনেক অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত। তারপরও পেয়েছেন পদোন্নতি। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ রহস্যজনক কারণে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. কোহিনুর আলম বর্তমানে পাউবোর পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে নিয়োজিত। এর আগে তিনি পাউবোর রাজশাহী সার্কেলের অধীন পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে রাজশাহীতে টেন্ডার টেম্পারিংসহ অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে সংশ্লিষ্টদের আন্দোলনের মুখে কর্তৃপক্ষ কোহিনুর আলমকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করেছিলেন।
এদিকে ওই সময় বিভাগীয় তদন্তে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়। তবে এ জন্য কর্তৃপক্ষ কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। উপরন্তু কয়েক মাস পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে পাউবোর পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্বে পদায়ন করা হয়। পাবনাতেও মো. কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে একই রূপ অনিয়ম ও অসদাচরণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। পাবনা সার্কেলের অধীন পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি লিখিত অভিযোগ করেছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, সচিব, পাউবোর মহাপরিচালক, পাউবোর রাজশাহী বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর। এসব অভিযোগের বিষয়ে পাউবো কর্তৃপক্ষ রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করেন। তদন্ত কর্মকর্তা রংপুর সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবু তাহের সম্প্রতি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, কোহিনুর আলম ইছামতি নদী খনন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের আগেই ঘনিষ্ঠ কয়েক ঠিকাদারের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা নেন কাজ দেওয়ার কথা বলে। যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের ঠিকাদারের কাছ থেকে নিজে যোগাযোগ করে টাকা নেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীকে চাপ দিয়েও টাকা আদায় করেন তিনি। তার অবহেলা, উদাসীনতা ও দুর্নীতির কারণে ইছামতি নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের প্রায় ৮ কোটি টাকা ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সূত্রের অভিযোগ মতে, ২০২২ সালের ১৯ জুন পাউবোর পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসাবে চলতি দায়িত্বে যোগদান করেন তিনি। তার বসবাসের জন্য পাবনাতে একটি এয়ারমার্ক বাসভবন থাকলেও তিনি থাকেন পাউবোর অতিথিশালায় এবং বিনা পয়সায়। নিয়মিত বাসা ভাড়া গ্রহণ করলেও অতিথিশালায় বসবাস করায় কোনো বাসা ভাড়া প্রদান করেন না কোহিনুর আলম। উপরন্তু অতিথিশালার ভাড়াও পরিশোধ করেন না। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বসবাসের সরকারি এই বাসাটি ২০১৯ সালে বেশ কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সংস্কার করা হয় বলে জানিয়েছেন পাবনা পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সূত্র মতে, পদোন্নতি পেয়ে পাবনায় যোগদানের পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন প্রকৌশলী মো. কোহিনুর আলম। অধীনস্থ ছোট বড় প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সর্ব ক্ষেত্রে অসদাচরণ করতে থাকেন। ২০২২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর মাস্টাররোলে নিয়োজিত কুক হযরত আলী ও গেটকিপার শীতল কুমার মহন্তকে ১/৩১৩নং স্মারকপত্রে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরি থেকে বাদ দেন। এই দুই চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে বাদ দিয়ে নিজ গ্রাম রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর থেকে নিকটাত্মীয় রানা আহমেদকে কুক ও পান্না খানকে গেট অপারেটর পদে ২০২২ সালের ২ অক্টোবর নিয়োগ দেন। এই দুই কর্মচারীকে কোহিনুর আলম নিজের দেহরক্ষী ও ব্যক্তিগত কাজের লোক হিসাবেও ব্যবহার করেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মো. কোহিনুর আলম অধীনস্থদের সঙ্গে শুধু দুরাচরণই করেন না, তাদের ওপর মানসিক পীড়ন করেন বলেও অভিযোগ করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। জানা গেছে, কোহিনুর আলমের মানসিক পীড়নে বিপর্যস্ত হয়ে গত এক বছরে পাবনা সার্কেল থেকে তিনজন নির্বাহী প্রকৌশলী দরখাস্ত দিয়ে অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে গেছেন। প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের অনৈতিক চাহিদার চাপ ও পীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন, একেএম মমিনুল ইসলাম ও সাখাওয়াত হোসেন নিজেরাই দরখাস্ত দিয়ে অন্যত্র বদলি হয়েছেন। আরেক নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দীন পাবনা থেকে বদলির জন্য চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগে আরও জানা গেছে, বয়সে প্রবীণ অথচ তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সঙ্গে কোহিনুর আলম কারণে-অকারণে অসদাচরণ করেন। ইতর ভাষা প্রয়োগ করে তাদেরকে গালাগালি দিয়ে থাকেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাউবোর পাবনা সার্কেলের অধীন বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কোহিনুর আলম যেন আনন্দ উপভোগ করেন। বাবার বয়সি কর্মচারীরাও রেহাই পান না। অধীনদের সঙ্গে সে যেসব আচরণ করেন তাতে তার মানসিক সুস্থতা নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, ২০২১ সালের শেষের দিকে মো. কোহিনুর আলম পাউবোর রাজশাহীর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ (পওর) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে যোগ দেন। এরপর ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েন টেন্ডার কেলেংকারি ও দুর্নীতিতে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ শুরু করলে বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন। সেই সঙ্গে বিভাগীয় ঠিকাদার সমিতিও কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সমাবেশসহ লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ফলে ২০২০ সালের ২০ আগস্ট পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় তাকে রাজশাহী থেকে প্রত্যাহার করে ঢাকায় প্রধান কার্যালয়ে সংযুক্ত করে। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে প্রতিবেদন দেয় মন্ত্রণালয়ে। তদন্ত কমিটি তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করার সুপারিশ দেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, কোহিনুর আলম চাকরিজীবনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও বগুড়া পাউবোতে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী থাকাকালে নানা বিশৃঙ্খলা করেন দাপ্তরিক কাজে। এত অভিযোগের পরও পদোন্নতি দিয়ে পাবনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসাবে বদলি করা হয়। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে রোববার দুপুরে ফোনে যোগাযোগ করা হলে মো. কোহিনুর আলম বলেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে হলে অফিসে আসতে হবে। সন্ধ্যার পর আবার ফোন দিলে তিনি কথা বলেন। তিনি বলেন, অবহেলা-দুর্নীতির কারণে ইছামতি নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের টাকা ফেরত যাওয়ার যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য তিনি দায়ী নন। অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করে কোহিনুর আলম বলেন, এমন কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। শত্রুতামূলকভাবে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।