Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ভাতা নিয়ে চিকিৎসকদের আন্দোলন

হিসাব মিলছে না ৩৬ কোটি টাকার

মন্ত্রণালয় বলছে সব টাকা দেওয়া হয়েছে, বিএসএমএমইউ বলছে সব টাকা দেয়নি * আন্দোলনের নামে রোগী সেবা বন্ধ করলে কোর্স আউট : ভিসি

Icon

জাহিদ হাসান

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হিসাব মিলছে না ৩৬ কোটি টাকার

ফাইল ছবি

আন্দোলনরত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) নন-রেসিডেন্স চিকিৎসকদের ভাতার হিসাব মিলছে না। পাওনা পুরো টাকা দেওয়া হয়েছে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু তা মানতে নারাজ বিএসএমএমইউ। তাদের দাবি এবার মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ৭৯ কোটি টাকা। এবার টাকা কম এসেছে। গত অর্থবছরে এসেছিল ১২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

এদিকে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা বলছেন, বিদ্যমান হারে প্রতিবছর আমাদের ভাতা বাবদ প্রয়োজন ৩৬ কোটি টাকা। সেটিই দিয়েছে মন্ত্রণালয়। তাহলে আমাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না কেন। বরং আমরা মনে করি, পুরো বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হওয়া জরুরি। তাহলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন যুগান্তরের কাছে এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা বলেন, দেড় হাজার চিকিৎসকের ৯ মাসের ভাতার অর্থ গেল কোথায়।

অপরদিকে বিএসএমএমইউ উপাচার্য আন্দোলনকারীদের জানান, তার কাছে বর্তমানে কোনো তহবিল নেই। এ অবস্থায় আন্দোলনের নামে কোনো চিকিৎসক রোগী সেবা থেকে বিরত থাকলে তাদের কোর্স আউট করা হবে। বুধবার এ ব্যাপারে নোটিশ জারি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বিএসএমএমইউ কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের যুগ্মসচিব (বাজেট অনুবিভাগ) মো. শহীদুজ্জামান বলেন, ‘বিএসএমএমইউ’র বাজেটের সম্পূর্ণ টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবারও তাদের অর্থ শাখার সঙ্গে কথা বলেছি। মন্ত্রণালয় থেকে টাকা পায়নি এমন কথা তারা আমাদের কাছে বলেনি। চিকিৎসকদের পাওনা টাকা কেন দিচ্ছে না, সেটা আমার কাছেও আশ্চর্য লাগছে। তারা সব টাকা এজি (মহাহিসাব নিরীক্ষক) অফিস থেকে নিয়ে চিকিৎসকদের দেবে বলেছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু তারা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ফলে বরাদ্দকৃত টাকা ফেরত পাঠানোর বিধান নেই। এই অর্থ তারা বিশ্ববিদ্যালয় খাতে রেখে দেয়, ফেরত দেয় না।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘গত বছর মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসকদের খরচ বাবদ ১২৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। এবার পেয়েছি ৭৯ কোটি টাকা। এবার টাকা কম এসেছে।

অন্যদিকে রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের দৈনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লগ বইতে সই করতে হয়। ফলে অনুপস্থিত থাকলে হাজিরা দেখানো সম্ভব নয়। ফলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চেয়ারম্যান চাইলে ওই প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকের কোর্স আউট করতে পারেন। কারণ এ সময় চিকিৎসকদের হাতে-কলমে শিখতে হয়। এটা বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলা হয়েছে।

এদিকে নন-রেসিডেন্সি কোর্সের চিকিৎসকরা যুগান্তরকে বলেন, তারা ফ্রন্টলাইনার। এ কারণে কর্মঘণ্টার বাইরে শুক্রবারসহ দিনরাত চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। তাদের মাসিক ২০ হাজার টাকা করে পারিতোষিক দেওয়া হয়। অথচ পাকিস্তানে নন-রেসিডেন্সি কোর্সের চিকিৎসকদের বাংলাদেশি টাকায় ৫৬ হাজার এবং ভারতে ৮০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। অবাক বিষয় হলো-স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনেক আগেই প্রশিক্ষণার্থীদের ভাতার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিএসএমএমইউর এ সংক্রান্ত চিঠিও আমাদের কাছে আছে। এরপরও বিএসএমএমইউ এক বছর ধরে প্রতিমাসে এই টাকার বিল জমা নিলেও চিকিৎসকদের অ্যাকাউন্টে দিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে কয়েকবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে জানানোর পর উনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয় না দিলে আমি কীভাবে দেব? ট্রেজারার (কোষাধ্যক্ষ) আর ডিরেক্টর ফিন্যান্স (পরিচালক অর্থ ও হিসাব) জানেন এ ব্যাপারে। এমনকি ভিসি স্যার আমাদের এও বলেন, ‘এই কয়টা টাকার লোভ তোমরা সামলাতে পারছ না’! দায়িত্বশীলদের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনে তারা রীতিমতো হতবাক।

ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ‘স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাবিষয়ক সম্পাদক’ বর্তমানে বিএসএমএমইউতে ২০২১-২০২৩ সেশনে নন-রেসিডেন্সি প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত আছেন ডা. রুহুল আমিন তুহিন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘উপাচার্যের আশ্বাসে কোষাধ্যক্ষের কাছে বেশ কয়েকজন গিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলেছি-আমরা ১ হাজার ৫০০ চিকিৎসকের প্রতিনিধি। আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড ছাত্রলীগের, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি অনুগত, আমাদের দ্রুত ভাতার টাকা অ্যাকাউন্টে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। অন্যথায় আন্দোলন হলে থামাতে পারব না।’ উনি তখন বলেন, ‘তোমাদের সাহস তো কম না। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সবাই ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ডের।’ সেখানে থেকে ডিরেক্টর ফিন্যান্স গৌরকুমার মিত্রের কাছে গেলে তিনি বলেন, ‘আমি খুলনার আওয়ামী পরিবারের সন্তান।’ পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তারা বিএসএমএমইউকে পাঠানো একটি চিঠির কপি ধরিয়ে দিয়ে জানায়, আপনাদের ১ হাজার ৫০০ চিকিৎসকের ১২ মাসের টাকা বিএসএমএমইউ’র নির্ধারিত অ্যাকাউন্ট নম্বরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ আপনাদের প্রতিমাসে ভাতার টাকা না দিয়ে অন্যায় করছে। আমরা বললাম, এর প্রতিকার কে করবে? উনারা বলেন, আমরাও বিরক্ত।’

বিএসএমএমইউর অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলেন, মন্ত্রণালয় যে চিঠি দিয়েছিল সেটি আইবাসে (সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তাদের বিল) আছে। কিন্তু আইবাসে কী থাকে সেটি মন্ত্রণালয় ছাড়া কেউ জানে না। প্রতিবছর সরকার বিএসএমএমইউকে একটি বরাদ্দ দেয়। এক্ষেত্রে কোন খাতে কত ব্যয় হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে কত টাকা দিয়েছিল সেটি আন্দোলনকারীদের বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই টাকাটা মন্ত্রণালয় দেয়নি। মন্ত্রণালয় আবাসিক ও অনাবাসিক দুই খাতেই দেয়, যেটি ডকুমেন্টস দেখলে বোঝা যাবে।

এফসিপিএস ট্রেইনি চিকিৎসক ডা. বেনজীর বেলাল খান বলেন, রেসিডেন্স চিকিৎসকদের সঙ্গে আমরা এফসিপিএস, এমডি, এমএসের আবাসিক চিকিৎসক, যারা ফেলোশিপের আওতায় থাকা চিকিৎসকরা ভাতা বাড়ানোর দাবি করছি। কিন্তু চার দিন অনুপস্থিত থাকলেই ফেল করা ও কোর্স আউটের বিষয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে।

অথচ বিএসএসএমইউর আইনে আছে, কোনো আবাসিকে ৩ মাসের অধিক অনুনমোদিতভাবে কোর্সে অনুপস্থিত থাকলে তার ভর্তিসহ কোর্স বাতিল করা যেতে পারে। তাহলে তারা ৩ দিন অনুপস্থিত থাকার বিষয়টি বলছেন কিসের ভিত্তিতে।

আন্দোলনরত চিকিৎসকরা আরও বলেন, বর্তমানে আমরা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছি। প্রতিবেশী ভারতে দিল্লির মাওলানা আজাদ মেডিকেল কলেজের প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের প্রথম বছর ১ লাখ ১০ হাজার ৫৩৩ রুপি, দ্বিতীয় বছর ১ লাখ ১৩ হাজার ৬০৩ রুপি এবং তৃতীয় বছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৬৭৩ রুপি ভাতা দেয়। বেঙ্গালুরের জওহরলাল নেহেরু মেডিকেল কলেজে প্রথম বছর ৬৮ হাজার ৫৪৫ রুপি, দ্বিতীয় বছর ৭৫ হাজার ৩৯৯ রুপি এবং তৃতীয় বছরে ৮২ হাজার ৯৩৮ রুপি ভাতা দেয়। এছাড়া কলকাতা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে প্রথম বছর ৪৫ হাজার ৭১ রুপি, দ্বিতীয় বছর ৪৮ হাজার ৫৩৮ রুপি এবং তৃতীয় বছরে ৫২ হাজার ৫ রুপি ভাতা দেওয়া হয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম