সোনারগাঁয়ে হকার থেকে কোটিপতি পলিথিন জাকির!
সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
একসময় বাজারে বাজারে হেঁটে হেঁটে পলিথিন বিক্রি করে কোনো রকমে জীবনযাপন করতেন জাকির হোসেন। সময়ের ব্যবধানে তিনি আজ অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার রয়েছে একাধিক বাড়ি, গাড়ি, অঢেল সম্পত্তি ও জমিজমা। হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন দামি গাড়ি। কিভাবে এত অল্প সময়ে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হলেন এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
সোনারগাঁ উপজেলার কান্দারগাঁও গ্রামের মোজাফ্ফর আলীর ছেলে জাকির হোসেন। জীবন নির্বাহের তাগিদে একসময় মাছ বাজারে পলিথিন ব্যাগ বিক্রি করত বলে এলাকায় তাকে ‘পলিথিন জাকির’ নামেই চেনে। পরে মেঘনা ঘাটে হকারির পাশাপাশি এলাকায় বালু ভরাট ও জমি বিক্রির দালালিও চালিয়ে যান সমান তালে।
উপজেলার কান্দারগাঁও এলাকার বাসিন্দা জাকির ওরফে পলিথিন জাকির জীবনের প্রথমে বৈদ্যের বাজার এলাকার খেয়াঘাটে ‘মেসার্স পিয়াল এন্টারপ্রাইজ’ নামে বৈদ্যের বাজার থেকে মেঘনা ঘাট পর্যন্ত ইজারা নেন। অতিরিক্ত চাঁদাবাজির কারণে তার ইজারা বাতিল করা হলে ‘কান্দারগাঁও যুব কল্যাণ সমিতি’র নামে আবারও ইজারা নেন। একই অভিযোগে তা বাতিল হলে পুনরায় ইজারা পায় কান্দারগাঁও গ্রামের একতা সংঘের সভাপতি আমজাদ হোসেন। কিন্তু ইজারার নিয়ন্ত্রণ থাকে জাকিরের হাতেই। ইজারা বাতিল হলেও জোরপূর্বক নৌপথে চাঁদাবাজি করতেই থাকে পলিথিন জাকির। সোনারগাঁ উপজেলায় নৌপথের চাঁদাবাজির একচ্ছত্র অধিপতি বনে যান জাকির ওরফে পলিথিন জাকির।
‘সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি’ নামে একটি আবাসন প্রকল্পের জমি ক্রয় ও বালু ভরাটের দায়িত্ব পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন জাকির। সাধারণ মানুষের জমি দখল, ভুয়া দলিলে জমি বিক্রি এবং বালু ভরাটের টেন্ডারবাজি করার পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জাকিরের নেতৃত্বে মেঘনা নদীতে চলাচলরত বিভিন্ন নৌযান থেকে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের প্রতিবাদে এলাকাবাসী কয়েকবার মানববন্ধন করলেও কোনো প্রতিকার পায়নি। নৌযান থেকে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে জাকিরের সন্ত্রাসী বাহিনীর ২০-২৫ জনের একটি দল। যারা তিন থেকে চারটি নৌকার মাধ্যমে এ কাজ করে থাকে। প্রতিটি নৌকায় ৬-৮ জন করে থাকে। তাদের রয়েছে গজারির লাঠি থেকে শুরু করে আধুনিক অস্ত্র। জাকিরের ছোট ভাই আল-আমিন নৌ-চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত বলে জানান এলাকাবাসী।
অভিযোগ রয়েছে, পলিথিন জাকির বিপুল সম্পদের মালিক এখন। উপজেলার কান্দারগাঁও এলাকায় বিশাল বহুতল ভবন করেছেন পলিথিন জাকির। তার পাশেই আট থেকে দশ বিঘা জমির উপর সেন্তুশাহ নামে একটি রিসোর্ট করেছেন। এ ছাড়া কান্দারগাঁও এলাকায় নামে বেনামে বিঘায় বিঘায় জমি রয়েছে তার। ঢাকার বনশ্রীতে আলিশান বাড়ি, নীলা সুপারশপ নামে বনশ্রীতে বিশাল সুপারশপসহ ঢাকার আবাসিক এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার। বর্তমানে তিনি অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।
জাকিরের নামে দুটি হত্যা ও নৌ-চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও মারামারিসহ প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে। পলিথিন জাকির ২০১২ সালে রিপন হত্যা, ২০১৪ সালে সাধন হত্যা ও ২০১৫ সালে গোলজার হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি খুন হয় জাকিরের সব অপকর্মের সাক্ষী ভাগিনা মোহাম্মদ আলী।
উপজেলার কান্দারগাঁও এলাকায় গড়ে তোলা সেন্তুশাহ রিসোর্টে কয়েকটি কক্ষ নির্মাণ করে সেখানে অসামাজিক কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
উঠতি বয়সের শিক্ষার্থী, যুবক, যুবতীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই রিসোর্টের কক্ষে সময় কাটাচ্ছেন। এতে ওই এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, চতুর জাকির তার সেকেন্ড ইন কমান্ড সাধন এবং ভাগিনা মোহাম্মদ আলীকে হত্যার আগে পরিকল্পিতভাবে অন্যকে ফাঁসিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের জন্য খুন হওয়ার দু-এক দিন আগে সোনারগাঁ থানায় তাদের নিরাপত্তা চেয়ে সে নিজে বাদী হয়ে সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরি করার দুদিন পর সাধন এবং এক দিন পর মোহাম্মদ আলী নৃশংসভাবে খুন হন।
স্থানীয়দের মধ্যে চাউর রয়েছে, পলিথিন জাকিরের ভাগিনা মোহাম্মদ আলী হত্যা মামলার ভয় দেখিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে বলেও জানা যায়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে মার্চ মাসে সোনারগাঁ উপজেলা যুবলীগ সম্মেলনের মাধ্যমে তৎকালীন দুটি হত্যা মামলাসহ প্রায় ডজন মামলার আসামি জাকিরকে পিরোজপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসাবে নাম ঘোষণা করা হয়।
আওয়ামী যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন জাকির ওরফে পলিথিন জাকির। যুবলীগের কমিটিতে সভাপতি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় নেতার সাথে তার ছবি ফেসবুকে ভাইরাল করে প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে অবৈধ সুবিধা আদায় করেন। বৈদ্যের বাজার খেয়াঘাটের ইজারা পাওয়ার পর তার বাহিনীর চাঁদাবাজি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক মাঝি ও গ্রামবাসী আনন্দ বাজারে চলে গেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোশাররফ হোসেন জানান, একসময়ে যার পরিচয় দেওয়ার মতো কিছুই ছিল না, সময়ের ব্যবধানে আজ সে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক। নদীপথে চাঁদাবাজি, হত্যার পর হত্যা সবশেষ ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হয়ে পলিথিন জাকির আজ এক অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন।
জাকিরের সাথে যোগাযোগ করতে কয়েকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাহবুব আলম সুমন জানান, জাকিরের বিরুদ্ধে থানায় হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। বর্তমানেও এলাকায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তার বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুর হাফিজ জানান, অপরাধীরা যেই দলের বা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন তাদের কোনো অবস্থাতেই ছাড় দেওয়া হবে না। জাকিরের অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র্যাপিড অ্যাকশন র্যাটালিয়ন-র্যাব-১১ এর অধিনায়ক তানভির মাহমুদ পাশা জানান, যুবলীগ নেতা জাকিরের মামলার বিষয়ে খোজখবর নেওয়া হচ্ছে। অভিযোগ প্রামাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।