Logo
Logo
×

শেষ পাতা

ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি-অসন্তোষ

Icon

সিরাজুল ইসলাম ও হাসিবুল হাসান, গাজীপুর থেকে

প্রকাশ: ২৬ মে ২০২৩, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি-অসন্তোষ

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোগান্তির নাম ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ভোটার শনাক্ত করতে আঙুলের ছাপ না মেলা, যান্ত্রিক ত্রুটি ও পর্যাপ্ত ভোটার প্রশিক্ষণ না থাকায় ভোটগ্রহণে ছিল চরম ধীরগতি। এতে ভোটকক্ষের বাইরে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে।

ভোট দিতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভোটকক্ষে ঢোকার পরও ভোট দিতে ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগেছে এমন কয়েকজন ভোটারও পাওয়া গেছে। ইভিএমে এমন ভোগান্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন অসংখ্য ভোটার। শুধু তাই নয়, এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন ভোট দিতে গেলে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাকে ২৮ মিনিট অপেক্ষা করতে হয়। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বড় ভাই আব্দুর রহমান খানও বিড়ম্বনায় পড়েন। আঙুলের ছাপ না মেলায় এ বিড়ম্বনায় পড়েন তিনি।

ইভিএমে বিড়ম্বনার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর রাজধানীতে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের বলেন, ইভিএম যেহেতু একটি মেশিন তাই মাঝে মাঝে সমস্যা হতেই পারে। ঝামেলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ঠিক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৫-১০ মিনিট পর সবাই ভোট দিতে পেরেছেন। অপরদিকে ভোট চলাবস্থায় বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শনের একপর্যায়ে এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ইভিএম প্রযুক্তি নতুন। প্রযুক্তির পরিচয় করাতে গেলে প্রথমে মানুষ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। তবে আমরা ভোটার এডুকেশন যথেষ্ট করেছি। বুথে বুথে দেখিয়ে দেওয়া হয়েছে কীভাবে ভোট দিতে হয়।

সরেজমিন দেখা গেছে, নারী ভোটারদের কেন্দ্রগুলোতে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। যেসব কেন্দ্রে নারী ভোটার ছিলেন সেখানে লাইনও বেশি ছিল। এছাড়া বয়স্ক ও কর্মজীবীদেরও প্রায় একই ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে ভোট দিতে টঙ্গীর আউচপাড়ায় নিউ ব্রোন স্কুল কেন্দ্রে যান জাতীয় পার্টির প্রার্থী এমএম নিয়াজ উদ্দিন।

এ কেন্দ্রের ৪ নম্বর কক্ষে তিনিই ছিলেন প্রথম ভোটার। তখন ওই ভোটকক্ষে ইভিএমে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ওই সময়ে মেয়র প্রার্থী সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একপর্যায়ে কন্ট্রোল ইউনিট পরিবর্তন করে ভোটগ্রহণ শুরু করা হয়। এতে ২৮ মিনিট অপেক্ষা করতে হয় তাকে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এমএম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, মেশিন চালু হতে একটু দেরি হয়েছে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভোট দিয়েছি।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী আজমত উল্লা খানের সঙ্গে ভোট দিতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন তার বড় ভাই আব্দুর রহমান খান। টঙ্গীর দারুস সালাম মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে তার আঙুলের ছাপ না মেলায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে বাসা থেকে স্মার্ট কার্ড আনিয়ে ভোট দেন তিনি। এ বিষয়ে আজমত উল্লা খান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ভোট দিতে তার (বড় ভাই) একটু ঝামেলা হয়েছে। স্মার্ট কার্ড আনার পর ভোট দিয়েছেন।

সকাল ৮টার দিকে সরেজমিন টঙ্গীর দারুস সালাম মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, শতাধিক ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। সকাল ৮টা ৬ মিনিট থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এদিকে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পরেই এই কেন্দ্রের দুটি কক্ষে ইভিএম মেশিনে সমস্যা দেখা যায়। দু-একজন ভোটার ভোট দেওয়ার পরপরই ভোটকেন্দ্রের ১ ও ২ নম্বর বুথে এ সমস্যা দেখা দেয়। এতে ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ ভোটাররা।

সাময়িকভাবে ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকে। এতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভোটারদের চাপ বাড়তে থাকে। ইভিএম মেশিন নষ্ট হওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রিসাইডিং অফিসার জাকির হাসান তালুকদার বলেন, ভোটগ্রহণ শুরুর একপর্যায়ে ভোটারের পায়ে লেগে মেশিন মাটিতে পড়ে যায়। এতে মেশিন আর কাজ করছিল না। তাই একটু সময় নিয়ে মেশিন বন্ধ করে পুনরায় চালু করা হয়। এতে সময় লেগেছে।

আরও দেখা গেছে, সকাল ১০টা ৫ মিনিটে সালনার পোড়াবাড়ী সাবেরিয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভোটারদের দীর্ঘ লাইন। ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতির কারণে বিরক্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। উত্তর সালনার বাসিন্দা সিরাজ মিয়া বলেন, দুই ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়েছি। লাইন এগোচ্ছে না। তাই বাড়ি চলে যাচ্ছি। দুপুরের পর ভিড় কমলে আবার আসব।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের তো আরও অনেক কাজ আছে। ভোট দিয়ে কী পেট চলব। উত্তর সালনার বাসিন্দা মো. ইসরাফিল বলেন, সকাল ৮টা ২০ মিনিটে যখন কেন্দ্রে প্রবেশ করি তখন প্রধান গেট পর্যন্ত ভোটারের লাইন ছিল। পৌনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর এখনো বুথের কাছে পৌঁছেনি। আমার সামনে আরও ১০ জন সিরিয়ালে আছে।

ইভিএমে ধীরগতির কথা স্বীকার করে এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, এ মেশিনে কীভাবে ভোট দিতে হয় তা মুরব্বিরা জানেন না। এজন্য ভোট নিতে দেরি হচ্ছে। ২৮৯১ জন ভোটারের এ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর প্রথম দেড় ঘণ্টায় ১৮৩টি ভোট পড়েছে। তিনি বলেন, ভোটের আগের রাতে মেশিন চেক করতে গিয়ে দেখি দুটি বুথের মেশিনের ঘড়িতে এক ঘণ্টা পেছানো ছিল। রাতেই কারিগরি কমিটির সদস্যরা এসে ঠিক করে দিয়ে যান।

ভোটগ্রহণের সময়ে মেশিনে সমস্যা হয়নি। এ প্রতিবেদককে যখন তিনি এসব কথা বলছিলেন তখন ওই কেন্দ্রের ৭ নম্বর বুথের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একজন ভোটার নিয়ে এসে বলেন, ওই ভোটারের আঙুলের ছাপ কোনোভাবেই মিলছে না। এজন্য তিনি ভোট দিতে পারছেন না। তখন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার আঙুলের ছাপ দিয়ে তাকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার পরামর্শ দেন।

বেলা ১১টায় সালনা নাসির উদ্দিন মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের (কেন্দ্র-২) মহিলা ভোটকেন্দ্রে দেখা গেছে, নারীদের দীর্ঘ লাইন। ৩১৭৭ জন ভোটারের এ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শুরুর প্রথম তিন ঘণ্টায় মাত্র ১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। ধীরগতির জন্য ভোটার এডুকেশন না হওয়াকে দায়ী করেন এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার।

তিনি বলেন, মেশিনই স্লো। এছাড়া প্রশিক্ষণ না থাকলে শিক্ষিতরাও কীভাবে ভোট দিতে হবে তা বুঝবে না। আর এ কেন্দ্রে অশিক্ষিত ভোটার বেশি। তাই ভোট নিতে বেশি সময় লাগছে। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, একজন নারী ভোটারের ভোট দিতে ২০ মিনিট সময় লেগেছে। আমাকে গিয়ে ওই সমস্যার সমাধান করতে হয়েছে।

সালনা মধ্য পাড়া থেকে ওই কেন্দ্রে ৭০ বছর বয়স্ক আনোয়ারাকে নিয়ে আসেন তারই প্রতিবেশী আকরাম হোসেন। ওই নারীর আঙুলের ছাপ না মেলায় তিনি ভোট দিতে পারছিলেন না। তাকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন আকরাম হোসেন।

পোড়াবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রেও ভোট দেওয়ার অপেক্ষমাণ নারীদের লম্বা লাইন ছিল। এ কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম মোল্লা বলেন, মেশিনই ধীরগতি। ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোটার শনাক্ত করতে সমস্যা হচ্ছে। আবার শনাক্ত করা গেলেও ভোটাররা কোন পদ্ধতিতে ভোট দেবেন তা অনেকেই বোঝেন না। এ কারণে ভোটগ্রহণে ধীরগতি হচ্ছে।

দুপুর সাড়ে ১২টায় মুন্নু টেক্সটাইল মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দুটি কেন্দ্রের (পুরুষ) সামনে কয়েকশ ভোটার লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভোট দিতে ধীরগতির কারণে এ দুটি কেন্দ্রের ভোটাররা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। আমির হোসেন নামের একজন ভোটার জানান, সকাল ৯টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। ইভিএমে ধীরগতির কারণে লাইনও এগোচ্ছে না।

সাড়ে চার ঘণ্টায় ১৫ ভাগও ভোট পড়েনি। এরমধ্যে নিচতলার কেন্দ্রের একটি ইভিএমে ত্রুটির কারণে কিছু সময় ভোট নিতে সমস্যাও হয়। নাজমুল আলম নামের ষাটোর্ধ্ব একজন ভোটারও একই কথা জানিয়ে বলেন, এত রোদের মধ্যে দাঁড়ানো কষ্ট হচ্ছে। আর আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পরও যদি ভোট দিতে না পারি বাসায় চলে যাবে।

এ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার পন্ডিত জানান, বয়স্ক ভোটারদের ইভিএমে ভোট দিতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকে ইভিএমে ভোট দিতে পারছেন না, তাদের সহযোগিতার মধ্যমে ভোট দিতে হচ্ছে। যে কারণে সময় বেশি লাগছে। সময় যাতে কম লাগে সে চেষ্টা করছি আমরা।

প্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে পূবাইল এলাকার নীলের পাড়া উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে। ভোটগ্রহণে ধীরগতির কারণে ২ হাজার ৫৯৯ জন ভোটারের মধ্যে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ৬৫৪টি। ভোট পড়ার হার ছিল ২৫ শতাংশ। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন গাজীপুর মডেল একাডেমি কলেজের শিক্ষার্থী সুবর্ণা আক্তার। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, অনেক রোদ, তাই দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। লাইন অনেক আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। বয়স্কদের বেশি কষ্ট হচ্ছে।

এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাহমুদ হাসান বলেন, বয়স্ক নারীদের ইভিএম মেশিনের বিষয়ে জ্ঞান কম। তাদের ভোট দিতে সময় বেশি লাগছে। তবে লাইনে দাঁড়িয়ে যাতে কষ্ট না হয়, সে জন্য বয়স্ক নারীদের আগে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতিও বেড়েছে।

শুধু এসব কেন্দ্র নয়, নগরীরর অন্তত একশ ভোটকেন্দ্র ঘুরে প্রায় একই ধরনের ভোগান্তির চিত্র পাওয়া গেছে।

এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি আব্দুল মালেক ও কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি আব্দুল গাফফার

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম